শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলাম ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে রক্তদান

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০২১, ১২:০৬ এএম

গ. রক্তদানের পক্ষে হাদীসে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতঃ রাসূল স.-এর একটি হাদীসে দূষিত রক্তকে উত্তম রক্ত দ্বারা বদলে দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যক্তির অসুস্থতার পর যথাযথ চিকিৎসা প্রদান তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ সতেজ করে তোলে। আতা ইবনে ইয়াসার রা. হতে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন,
যখন কোন মানুষ রোগাক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ তা’আলা তার কাছে দুজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং তাদের বলেন, দেখ! অসুস্থ ব্যক্তি তার সেবাকারীদেরকে কি বলছে। যদি ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার শুকর করতে থাকে তবে ফিরিশতাদ্বয় আল্লাহ তা’আলার কাছে সে সংবাদ নিয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি যদি তাকে মৃত্যু দেই তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যদি তাকে রোগ থেকে মুক্তি দেই তবে তার খারাপ গোশতকে ভাল গোশত দ্বারা এবং দূষিত রক্তকে উত্তম রক্ত দ্বারা বদলে দেব এবং তার গুনাহ ক্ষমা করে দেব।
অগ্রগণ্য মতঃ রক্তদান সম্পর্কিত আলিমদের উভয় পক্ষের মতামত ও প্রমাণাদি বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, রক্তদান সংক্রান্ত মত দুটি অবস্থা নির্ভর। ইসলামে স্বাভাবিক অবস্থায় অন্যান্য খাদ্যের মতো রক্তও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। রক্তদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন বিষয়, যাতে চিকিৎসকের পরামর্শ, দাতা ও গ্রহীতার উপযোগিতা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এ পদ্ধতির ওপর মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণে ইসলামের অনুমোদন রয়েছে। কেননা ইসলামী শরীয়ার অন্যতম লক্ষ্য ‘জীবন রক্ষা’ এ পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট। রক্তদান কেবল বিশেষ প্রেক্ষাপটেই সম্পন্ন করা হয়, যেখানে রোগীর জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। এমতাবস্থায় শরীয়তের ‘সংকটকালে নিষিদ্ধবস্তু বৈধ হওয়া’- এর নীতি প্রয়োগযোগ্য। আলিমগণের এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। সর্বোপরি বলা যায়, চিকিৎসকের পরামর্শের ভিত্তিতে দাতা ও গ্রহীতার উপযোগিতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের প্রতি ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক।
রক্তদানের ফিকহী নীতিমালাঃ
রক্তদানের ক্ষেত্রে ফকীহগণ ভিন্ন ভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। উক্ত নীতিমালা অনুসরণ করে রক্তদান করা উচিৎ।
এর ব্যত্যয় হলে শরীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা বৈধ হবে না। উপরোল্লিখিত বিভিন্ন ফিকহ বোর্ডের প্রদত্ত শর্তাবলির ভিত্তিতে নিম্নে এ সম্পর্কিত নীতিমালা তুলে ধরা হলো:
ক. রক্তদান আবশ্যক বা প্রয়োজনীয় হিসেবে প্রতীয়মান হওয়া;
খ. রক্তদান ছাড়া রোগীর রোগমুক্তি ও সুস্থতা সম্ভব নয় বলে প্রতীয়মান হওয়া;
গ. রক্তদানের কারণে রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার কোন ক্ষতি না হওয়া;
ঘ. বিশেষজ্ঞগণের প্রবল ধারণায় রক্তদানের মাধ্যমে রোগী উপকৃত হওয়া;
ঙ. রক্তদাতা রক্তদানের বিনিময়ে কোন প্রকার আর্থিক বিনিময় নিতে পারবে না; কেননা হাদীসে স্পষ্টভাবে রক্ত বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাছাড়া রক্ত ক্রয় বিক্রয় হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা সাব্যস্ত হয়েছে।
চ. রক্তদানের বিনিময়ে উপহার, উপঢৌকন গ্রহণের দুটি ধরন হতে পারে, এক- পূর্ব থেকে শর্তযুক্ত, এ ধরনের বিনিময় রক্ত বিক্রয় হিসেবে গণ্য বিধায় তা বৈধ হবে না; দুই- যদি এ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মানবিক কাজ করার কারণে কোন প্রকার শর্ত ছাড়া উৎসাহ ও প্রণোদনামূলক কিছু উপঢৌকন প্রদান করে তবে তা বৈধ;
ছ. রক্তদাতা সন্তুষ্টচিত্তে রক্ত দিতে রাজী হবেন। তার থেকে জোরপূর্বক রক্ত নেয়া যাবে না। কেননা রক্ত তার শরীরের একটি অংশ, যাতে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ স্বীকৃত;
জ. যতটুকু রক্ত গ্রহণ প্রয়োজন ও নিরাপদ শুধুমাত্র ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে। কেননা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অথবা রক্তদাতা বা গ্রহীতার জন্য ক্ষতিকর এমন মাত্রায় রক্ত গ্রহণ করা হলে তা শরীয়ার দৃষ্টিতে বৈধ হবে না।
রক্তদানের নৈতিক দিকঃ কোন ব্যক্তি তার দেহের রক্ত অতীব প্রয়োজনীয় মুহুর্তে দান করা অবশ্যই ত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত। কোন মানুষের উপকারে এরূপ সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান অতি উচ্চ দয়া ও অনুকম্পার বিষয়। রাসূল স. কঠিন মুহুর্তে জীবন রক্ষার কাজে এগিয়ে আসাকে আল্লাহর নিকট অতীব সাওয়াবের কর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একটি ইতর প্রাণীর জীবন রক্ষাকেও মহাপুণ্যের কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। একজন মহিলা বেশ কষ্ট করে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে একটি পিপাসার্ত কুকুরের তৃষ্ণা নিবারণে সাহায্য করল। এই ক্ষুদ্র একটি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্যই মহিলাটি দোজখে যাওয়া থেকে রক্ষা পেল। রাসূল স.-এর পবিত্র মুখনিঃসৃত এ বহু মূল্যবান প্রাজ্ঞ ঘটনাটির মধ্যে আমাদের শিক্ষার বহু উপকরণ রয়েছে। প্রথমত কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কাজটি করা হয়েছে এবং দ্বিতীয়মত তার হৃদয়ের ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতার স্তর। একট তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করানো কোনো অসাধারণ ঘটনা নয়, অথচ হাদীসে বর্ণিত ছোট্ট সৎকর্মটির প্রকৃত মূল্যমান বিশাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসলাম কষ্ট ও গ্লানিমুক্ত পারস্পরিক নির্ভরতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সামাজিক জীবন গঠনের দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। পবিত্র কুর’আনে ভালো ও ন্যায়ের কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা করা এবং অন্যায়মূলক কাজে কারো সহযোগিতা না করাকে একটি মূলনীতিরূপে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, কল্যাণমূলক ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালংঘনমূলক কাজে কারো সহযোগিতা করো না।
ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের আদান-প্রদান, আন্তরিকতার বহি:প্রকাশের মাধ্যমে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। আতা বিন আবি মুসলিম আল-খুরাসানী বলেন, রাসূল স. বলেছেন, তোমরা পরস্পর মুসাফাহা কর, বিদ্বেষ লোপ পাবে। একে অপরকে হাদিয়া প্রদান কর, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে এবং ঘৃণা দূরীভূত হবে।
আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাই এ ভ্রাতৃত্ব-সম্পর্ক রক্ষা করা আবশ্যক। ভ্রাতৃত্বের এ সম্পর্ক বিভিন্নভাবে রক্ষা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে জীবন, সম্পদ বা কথা দিয়ে মুসলিমের জীবনে পারস্পরিক সাহায্য করা যায়। পারস্পরিক সহমর্মিতা তথা অন্যের ব্যথিত হওয়া এবং তার আনন্দে আনন্দিত হওয়ার মাধ্যমেও সাহায্য-সহযোগিতা করা যায়। রাসূলুল্লাহ স. বলেন, তুমি দেখবে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ও সহমর্মিতার ক্ষেত্রে মুমিনরা একই দেহের মতো। এ দেহের একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে অন্য অঙ্গসমূহ এর জন্য ব্যথিত হয়। জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ে ও বিনিদ্র রজনী কাটায়। আর কোনো মুসলিম অসুস্থ হলে তার যথাসম্ভব সেবা করা পারস্পরিক অধিকারের মধ্যে একটি অধিকার ও দায়িত্ব। ইসলাম প্রত্যেক মুসলিমকে তার সমাজের ব্যক্তিবর্গের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা নিষেধ করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন