বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

লকডাউনে উপায়হীন দিনমজুর

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

সরকার গত বছর প্রথম যখন দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছিল, তখন দেশের দিনমজুরদের জন্য খাবার বরাদ্দ ছিল। অবশ্য বরাদ্দ পর্যাপ্ত ছিল না। আবার কাঙ্খিত ব্যবস্থাপনা না থাকায় বণ্টন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নও হয়নি। অনেকে খাদ্য পেয়েছিল, অনেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়। দেশে করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্তের হার খুলনা বিভাগে ৪০ শতাংশ আর রংপুর বিভাগে ৩৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সকল বিভাগে আক্রান্তের হার ২০ শতাংশের উপরে। এমতাবস্থায় ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। জনগণের রাস্তায় বের হওয়ার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার। অফিস-আদালত ও অধিকাংশ কল-কারখানা বন্ধ। রাস্তায় জনসমাগম খুব একটা নাই। কিন্তু কাঁচাবাজার, মাছের বাজার ও গ্রামগঞ্জের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাস্তায় লকডাউন থাকলেও কাঁচাবাজার, মাছের বাজার ও গ্রামগঞ্জে তা অনুপস্থিত। রাস্তায় লকডাউন কার্যকরে কঠোর অবস্থানে প্রশাসন। মাঠে আছে পুলিশ, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী। আছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে ম্যাজিস্ট্রেট। ইতোমধ্যে শত শত মানুষকে আটক করা হয়েছে। অনেকের শাস্তি ও জরিমানা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে অনেকে দিনমজুর রয়েছে বলে জানা গেছে।
এবারের লকডাউনকে কেউ কেউ শাটডাউন বলেও মন্তব্য করেছেন। এবারের লকডাউনে দিনমজুরদের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে অভাবী মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে পড়েছে। দেশে অভাবী দিনমজুরের সংখ্যা বিপুল। লকডাউনে সবচেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে এসব মানুষ। দিনমজুরেরা দিন আনে দিন খায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখ। শিল্পে নিয়োজিত আছে ১ কোটি ২৪ লাখ। আর সেবা ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা ২ কোটি ৩৭ লাখ। সম্পূর্ণ বেকার আছে ২৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। আর বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ১ কোটি ১১ লাখ মানুষ আছেন যারা পরিশ্রম করেন, কিন্তু পারিশ্রমিক পান না। ১ কোটি ৬ লাখ মানুষ আছেন এমন দিনমজুর যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর। এ লকডাউনে তাদের জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নাই। লকডাউনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব নিম্ন আয়ের মানুষ।

করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধির এ গতি দীর্ঘ হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসনের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা আপাতত দৃশ্যমান নয়। ঘোষিত বাজেটেও তাদের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বাজেটে জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলা হলেও এসব অভাবী মানুষ উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রেস্টুরেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালক, গ্রামের কৃষক, নদী পাড়ের জেলে, নির্মাণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র দোকানি ও বিদেশ ফেরত মানুষ। অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে কর্মজীবী শ্রমিকের সংখ্যা ছয় কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ হলো কৃষিজীবী। বাকি ৪ কোটি মানুষ কাজ করে সেবা ও শিল্প খাতে। আর এদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক। তারা অনেকটা ভাসমান শ্রমিক হিসেবেই কাজ করে থাকে। তাদের আয়ের নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে। করোনা মহামারীর কারণে এ সমস্ত মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এ মানুষগুলোর আয় নেই, সঞ্চয় নেই। চাল-চুলাও নেই। এসব দিনমজুরের পারিবারিক জীবনে শোচনীয় অবস্থা বিরাজ করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে মজুরি ও বেতনভোগী শ্রমিক আছে দুই কোটি ৪২ লাখ। এ সমস্ত শ্রমিক দৈনিক ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মজুরির বিনিময়ে কাজ করে থাকে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকায় তাদের আয় নেই বললেই চলে। একজন রিকশাচালক যেখানে দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করত, এখন সে ২০০ টাকাও আয় করতে পারছে না। অধিকাংশ কল কারখানা এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঐসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা এখন বেকার। তাদের বিকল্প আয়ের কোনো উৎস নেই। অন্যান্য শ্রমিকদেরও একই অবস্থা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস’ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯২ হাজার। কৃষি ব্যবস্থা চালু থাকায় তারা মোটামুটি কোনোমতে চলতে পারছে। ঐ একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নির্মাণ ও আবাসন শ্রমিক আছে ৩৬ লাখ। এসব শ্রমিকের মধ্যে রয়েছে কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, রড মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি, শাটার মিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, টেকনিশিয়ান, হেল্পার ও মেশিন অপারেটর। এদের সাধারণত কোনো নিয়োগপত্র থাকে না। অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিতে তারা কাজ করে থাকে। কিন্তু লকডাউন ও শাটডাউনের কারণে তাদের সব কাজই বন্ধ। বিবিএস এর অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মুদি দোকানশ্রমিক ও মোটরশ্রমিকের সংখ্যা ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার। এসকল দোকান স্বল্প পরিসরে খোলা থাকায় এ পেশায় নিয়োজিত ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক একরকম বেকার হয়ে আছে। তারা চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছে। সারাদেশে পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫২ লাখ। গাড়ি বন্ধ থাকায় তাদের পারিবারিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দেশে ১২টি স্থলবন্দরে প্রত্যক্ষভাবে শ্রমিক আছে ৩০ হাজার। আর পরোক্ষভাবে কাজ করে এমন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। বন্দরগুলো বন্ধ থাকায় এসব শ্রমিকের পরিবারে হতাশা নেমে এসেছে।

শাটডাউন বা লকডাউন যাই হোক না কেন এসমস্ত শ্রমিকের কথা বিবেচনায় আনা দরকার। লকডাউন পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো বৃদ্ধি হতে পারে। এমতাবস্থায় লকডাউন বাস্তবায়ন হওয়া চ্যালেঞ্জিং। কারণ এসব ছিন্নমূল মানুষ করোনাকে ভয় পায় না। তাদের কাছে করোনার যাতনার চেয়ে পেটের যাতনাই বড়। তাদের পেটে ভাত নাই। ঘর ভাড়ার টাকা নেই। কলসিতে চাল নাই। তাদের কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজেশন, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া আর মাস্ক পরিধান স্বপ্নবিলাসের মতো। ৫ টাকার মাস্ক (ক্ষেত্রবিশেষ ১০ টাকা) আর ৩ ফুট দূরত্বে অবস্থান তাদের কাছে এখন অর্থহীন। সামনে ঈদুল আযহা থাকায় শাটডাউনটি তাদের কাছে আরো বেশি বিরক্ত ও বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা আনুষ্ঠানিক বেতনভুক্ত কর্মজীবীমানুষ তাদের ঘর থেকে বের না হলেও চলবে। তাদের বাজারে যাওয়া লাগে না। তাদের ঘরে বস্তাভর্তি বাসমতি চাল মজুদ আছে। ফ্রিজে ভর্তি মাছ আছে। আছে মাংস, অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য। ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের অবস্থাতো আরো একধাপ উপরে। তাদের ব্যাংকে আছে টাকা। অন্যান্য সামগ্রীরও অভাব নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বেশ সুখে আছেন। ঘরে বসেই পাচ্ছেন বেতন। খেয়েপরে মন এবং শরীর নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আছেন তারা। কিন্তু নি¤œ আয়ের এ সকল শ্রমিক ও দিনমজুরদের কথা কেউ ভাবছেন না। তাই এ সব মানুষের ঘরে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ঘরে বসে তাদের আহার জুটছে না। তাদের সন্তানদের মুখে খাবার যাচ্ছে না। তাদের জঠরজ্বালাও মিটছে না। এ জ্বালা মেটাতে তাদের বাইরে আসাই লাগবে। তাই তারা শাটডাউন এবং লকডাউন মানতে নারাজ।

একজন পরিবহন শ্রমিকের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বক্তব্যটি অনলাইনে ভাইরাল হয়ে গেছে। একজন সাংবাদিককে তিনি বলছেন, ‘আমার ফ্যামিলিতে লোক ৫ জন। মাসে লাগে আমার ৪০ কেজি চাউল। সুতরাং দুই কেজি চাউলের লকডাউন আমি মানি না। এগুলো তামাশা। এ তামাশা বন্ধ করতে হবে। হয় আমাদের ঘরে এক মাসের ৪০ কেজি চাল দিতে হবে। না হয় আমাদের কাজ করতে দিতে হবে। আমরা পরিবহন শ্রমিক নির্যাতিত-নিপীড়িত গোষ্ঠী। আমরা কাজ করে ভাত খেতে চাই। আমরা করোনাকে ভয় পাই না, ভয় পাই লকডাউনকে। করোনায় মরে গেলে শহীদ হবো। কিন্তু লকডাউনে না খেয়ে মরতে পারবো না। করোনায় গরীব মানুষ মরে না। গরীবেরা মরে, না খেয়ে।’ এসব দিনমজুরের বিষয়টি রাষ্ট্রের গুরুত্ব দেয়া উচিত। তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাই এ সময় তাদের ঘরে ন্যূনতম দু’ সপ্তাহের খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় নিন্মোক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে:
৩০ জুন ২০২১ তারিখে বাজেট পাস হয়েছে। ২০২১-২০২২ সালের বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। বিশাল এ বাজেট থেকে উল্লেখিত সংখ্যক দিনমজুরদের জন্য ১৪ দিনের অগ্রিম বাজেট ব্যয় করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে ১৪ দিনের জন্য একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। জনপ্রতি দিনে ১০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। এতে একজন মানুষের ১৪ দিনে ১৪শ’ টাকা ব্যয় হবে। তিন কোটি ৯৫ লক্ষ মানুষের জন্য ব্যয় হবে ৫ হাজার ৫ শত ৩০ কোটি টাকা। যা সমগ্র বাজেটের ০.৯২% মাত্র। গৃহীত এ কর্মসূচি তাদের পরিবারে একটু হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে বলে ভুক্তভুগিরা মনে করে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম যাতে না হয়, তা তীক্ষ্ণ নজরে রাখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন