ইউরোপে ধারাবাহিক মানব পাচারের কারণে কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আশিকের নাম হয়ে যায় ‘ইউরো আশিক’। যিনি নৌপথে ইউরোপে মানব পাচারকারী ‘রুবেল সিন্ডিকেটের’ প্রধান সমন্বয়ক। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শুধুমাত্র দেশের একটি অঞ্চল থেকে গত দুই বছরে ৮০ জনকে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রটি ইউরোপ যেতে ইচ্ছুকদের নির্বাচিত করে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই হয়ে লিবিয়া পাঠায়। এ চক্রের সাথে একটি এয়ারলাইন্সের যোগসাজশের তথ্য পাওয়া গেছে। নির্ধারিত টাকা পরিশোধ হলে সুবিধামতো সময়ে ভ‚মধ্যসাগর হয়ে নৌকাযোগে বিপজজনক ইউরোপযাত্রা শুরু হয়। গত শনিবার র্যাব সদরদফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮-এর সমন্বিত অভিযানে ইউরো আশিকসহ (২৫) এই চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতরা হলো- আজিজুল হক (৩৫), মিজানুর রহমান মিজান (৪৩), নাজমুল হুমা (৩১), সিমা আক্তার (২৩), হেলেনা বেগম (৪২) ও পলি আক্তার (৪৩)। তাদের গ্রেফতার করা হয় মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী থেকে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৭টি পাসপোর্ট, ১৪টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ২টি এটিএম, ১৫টি ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার বই, ২টি হিসেবের নথি, ২টি এনআইডি কার্ড, ১০টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৫৬ হাজার ৬৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, আশিক ২০১৭ সালে এইচএসসিতে অকৃতকার্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। সেখানে দুই বছর অবস্থান করে মামা রুবেলসহ চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে মানব পাচারের কৌশল রপ্ত করে দেশে ফেরেন। এরপর ২০১৯ সাল থেকে দেশে অবস্থান করে রুবেল সিন্ডিকেটের মূল সমন্বয়ক হিসেবে মানবপাচারের কাজ চালিয়ে আসছেন। চক্রটি দেশের মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর এলাকায় বেশ সক্রিয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার টালি খাতা অনুযায়ী এই অঞ্চলের অন্তত ৮০ জনকে ইউরোপে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে সিলেট-সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়ও তাদের এজেন্ট রয়েছে বলে জানা গেছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপ যাত্রা শেষ হলে ভিকটিমদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেয়া হতো, কিন্তু খাতায় ১১ জনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেয়া নেই। এই ১১ জনের কোনো তথ্যও তারা দিতে পারেননি। সর্বশেষ গত ১৯ জুন ১৩ জনকে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
দুবাই বসেই মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ রুবেলের : র্যাব জানায়, ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত লিবিয়ায় অবস্থানকালে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ হয় রুবেলের। পরে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসে মানবপাচার সংক্রান্ত রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় তিনি দুবাইতে অবস্থান করে মানবপাচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। দেশ থেকে আশিকের নির্ধারিত লোকদের নামে অনলাইনে ভিসা ইস্যু করে দুবাই নিয়ে যান রুবেল। এরপর তাদের লিবিয়ার বেনগাজিতে পাঠান। সেখান থেকে চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ত্রিপলিতে নিয়ে নৌযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়। আর রুবেলের ভাগিনা আশিক, স্ত্রী সীমা, দুই বোন হেলেনা ও পলি দেশ থেকে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুকদের নির্বাচনসহ সকল ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। সকল ধরনের আর্থিক লেনদেনও হয় তাদের অ্যাকাউন্টে। র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে চক্রের এজেন্টরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে স্বল্প আয় ও স্বল্প শিক্ষিতদের নির্বাচিত করে। এরপর তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথি নিয়ে নেয়। ইউরোপ যাত্রার জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে ৭-৮ লাখ টাকার চুক্তি হয়। প্রথমে ৪-৫ লাখ টাকা নেয়া হয়। আর লিবিয়া পৌঁছানোর পর বাকি টাকা নেয়া হয় স্বজনদের কাছ থেকে। ভিসা পাওয়া, টিকিট কাটা থেকে সার্বিক প্রক্রিয়া চক্রের সদস্যরা করে থাকেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছার আগে পাসপোর্টসহ সকল নথি চক্রের হাতেই থাকে। পরের ধাপে টুরিস্ট ভিসায়, ক্ষেত্র বিশেষে বিজনেস ভিসায় তাদেরকে প্রথমে দুবাই নেয়া হয়। সেখান থেকে ‘মারাকাপা’ ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে ভিকটিমদের লিবিয়া পাঠান রুবেল। আর এই ট্রানজিটে একটি এয়ারলাইন্সের যোগসাজশের তথ্য পাওয়া গেছে। এয়ারলাইন্স এজন্য বাড়তি অর্থ না নিলেও ট্রানজিটের মাধ্যমে ভিকটিমদের লিবিয়ায় পৌঁছে দিতো। তদন্তের প্রয়োজনে তিনি ওই এয়ারলাইন্সের নাম প্রকাশ করেননি।
তিনি বলেন, লিবিয়ার বেনগাজি থেকে চক্রের সদস্য গাজী, কাজী ও বাবুল ভিকটিমদের রিসিভ করে ত্রিপলি নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে শুধু বাংলাদেশ না অন্যান্য দেশ থেকে পাচারের জন্য আনা লোকদেরও রাখা হতো। সেখানে অবস্থানকালীন পুরো টাকা পরিশোধ করলে সুবিধামতো সময়ে রাতে ভ‚মধ্যসাগর হয়ে ৫-৬টি নৌকা একসঙ্গে ভিকটিমদের নিয়ে রওনা দিতো। একেকটি নৌকায় ধারণক্ষমতা ৪০-৫০ জন হলেও ১০০-১২০ জন নিয়ে নৌকাগুলো বিপজজনক যাত্রা করতো। এর ফলে পথিমধ্যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতো প্রতিনিয়তই।
তিনি বলেন, সম্প্রতি গত ২৮ ও ২৯ জুন অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সময় ঊমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে প্রায় ৪৩ জন নিখোঁজ হয়। তিউনিশিয়ার উপকূলে বিধ্বস্ত নৌকা থেকে ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। তারমধ্যে বাংলাদেশ, সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া ও চাঁদের নাগরিক রয়েছে বলে জানা যায়। আরও ৪৯ বাংলাদেশি উদ্ধারের সংবাদ জানা গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন