শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

আর্জেন্টিনার কোপাজয়

নেইমারকে কাঁদিয়ে হাসলেন মেসি ব্রাজিল ০-১ আর্জেন্টিনা

রেজাউর রহমান সোহাগ | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

পৃথিবীর কোটি কোটি ভক্তদের আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে কোপা আমেরিকা ফুটবলের ৪৮তম আসরের শিরোপা জয় করে নিয়েছে ফুটবল বলতে সারা পৃথিবী যাকে বোঝে, যাকে চেনে, যাকে জানে সেই ফুটবল জাদুকর ডিয়াগো ম্যারাডোনর দেশ আর্জেন্টিনা। রোববার ব্রাজিলের রিও জেনিরোর বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে বিশ্বের সেরা ফুটবলার ও ম্যারাডোনার যোগ্য উত্তরসূরি লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে লাতিন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তোলে। আর্জেন্টাইন সুপারস্টার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ম্যাচের ২২তম মিনিটে জয়সূচক গোলটি করেন। ডি মারিয়ার ঠান্ডা মাথার পায়ের কাজের এই গোলটি ছিল খুবই দৃষ্টিনন্দন।

শিরোপা জয়ের পাশাপাশি আর্জেন্টাইন অধিনায়ক মেসি জেতেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা ফুটবলারের পুরস্কার। ডি মারিয়া হন ম্যাচসেরা আর আর্জেন্টিনার কাপ জয়ের অন্যতম নায়ক গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের হাতে ওঠে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার। সব মিলিয়ে এবারের কোপা আমেরিকা আসরেই ছিল আর্জেন্টাইনদের একচ্ছ্বত্র জয়জয়কার।

এর মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর ফুটবল ভক্তদের দীর্ঘ দিনের এক স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণ হয় প্রথমবারের মতো মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের হাসিতে। বিশ্বসেরা ফুটবলার মেসির যে ক্যারিয়ার তাতে জাতীয় দলের হয়ে এই কাপ জয় মেসির জন্য একেবারেই অপরিহার্য ছিল। পাশাপাশি ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ছিয়াশির বিশ্বকাপ জয়ের পর পরবর্তী বিশ্বকাপগুলোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে আর্জেন্টিনার কোনো সাফল্য না থাকায় দলটির সমর্থকরাও ধারাবাহিক হতাশায় হয়ে পড়েছিলেন অনেকটাই বাকরুদ্ধ। সবশেষ ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপাই জিতেছিল তারা। এবার জিতে স্পর্শ করল টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ১৫ শিরোপা জয়ের রেকর্ডধারী উরুগুয়েকে। সেই সাথে হতাশায় নিমজ্জিত আর্জেন্টাইন সমর্থকদেরও যেন উদ্ধার করেলেন মেসি। সেটিও যে কম অপরিহার্য ছিলনা আর্জেন্টাইন ফুটবলের জন্য! উল্টোরথে প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে ব্যর্থ হলো ব্রাজিল; আগের পাঁচ আসরেই শিরোপা জিতেছিল তারা। সব মিলিয়ে মহাদেশীয় এই মুকুট ৯ বার মাথায় তুলেছে ব্রাজিল। লাতিন ফুটবলের সেরা এই টুর্নামেন্টে দেশের মাটিতে তারা হারল ১৯৭৫ সালের পর এই প্রথম।

ফুটবল তীর্থে বর্ণিল লেজার শো দিয়ে শুরু হয় ম্যাচটি। পোড়ানো হয় আতশবাজি। গোটা টুর্নামেন্ট যেখানে উপেক্ষিত ছিল মাঠের প্রাণ দর্শক, ফাইনালে সেই কাক্সিক্ষত সুযোগ পেয়েছিলেন হাজার আটেক সমর্থক। অসংখ্য ফাউলে বারবার খেই হারানো ম্যাচে প্রথম ভালো সুযোগটা পান নেইমার। ত্রয়োদশ মিনিটে রিশার্লিসনের পাস পেনাল্টি স্পটের কাছে পেয়ে ঠিকমতো শট নিতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষের পায়ে প্রতিহত হয়। তবে নিজেদের প্রথম ভালো সুযোগেই স্বাগতিকদের স্তব্ধ করে দেয় আর্জেন্টিনা। নিজেদের অর্ধ থেকে রদ্রিগো ডি পলের পাস পেয়ে যান ডি মারিয়া। মাঝ পথে বল থামানোর সুযোগ ছিল রেনান লোদির, পারেননি তিনি। পিএসজি মিডফিল্ডার বল রিসিভ করে দুর্দান্ত চতুরতার সঙ্গে আগুয়ান গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে পাঠান জালে। গত বিশ্বকাপের পর এই প্রথম জাতীয় দলের হয়ে গোল পেলেন ডি মারিয়া। আর তাতে ২০০৫ কনফেডারেশন্স কাপের ফাইনালের পর এই প্রথম কোনো ফাইনালে গোল পেল দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরাই।

পিছিয়ে পড়ে একের পর এক আক্রমণে আর্জেন্টিনার রক্ষণের পরীক্ষা নেয় ব্রাজিল। কিন্তু গোলরক্ষক মার্টিনেজ ছিলেন আস্থার প্রাচীর হয়ে। প্রতি আক্রমণ নির্ভর ফুটবল খেলে লিওনেল স্কালোনির দলও। তারাও পারেনি এদেরসনের তেমন কোনো পরীক্ষা নিতে। এই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ‘ব্রাজেন্টিনা’ ম্যাচের যে উত্তাপ তা টের পাওয়া গেছে দু’দলের ৪১টি ফাউল আর ৯টি হলুদ কার্ডে। যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে রদ্রিগো পলের একটি চেষ্টা দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন এদেরসন। খেলার শেষ মুহূর্তে মেসি গোল করার যে অপূর্ব সুযোগটি পেয়েছিলেন সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কষ্ট আর হতাশা অনেকটাই দূর হয়ে যায় তাৎক্ষণিক মেসির মুখের হাসি দেখার পর। বাকি সময়টুকু কোনোমতে কাটিয়ে দিয়ে মারাকানায় প্রথমবার কোনো শিরোপা জয়ের উৎসবে মাতে আর্জেন্টিনা।

করোনার ভায়াবহ ছোবলে সারা পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত এবং এলোমেলো, ঠিক সেইরকম একটি পরিস্থিতিতেও এই কোপা আমেরিকা ফুটবলের ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে হতাশাগ্রস্থ মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও যেন আনন্দ প্রকাশের একটি প্রাণবন্ত উপলক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে। গোটা পৃথিবীই প্রতীক্ষায় ছিল এই ম্যাচকে ঘিরে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষও উৎসবে মেতে ছিল এই ম্যাচ দেখার প্রত্যাশায়। ব্রক্ষণবাড়িয়ায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও উত্তেজনার ঘটনাটি এখন শুধু স্থানীয় মিডিয়ায় নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করেছে। তবে আর্জেন্টাইন ভক্তদের এত আনন্দের মাঝেও বিষাদের বিষয়টি হচ্ছে, যে ম্যারডোনাকে ঘিরে সারা পৃথিবীতে আর্জেন্টিনার ব্যপক পরিচিতি ও আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা সেই ম্যারাডোনা দেখে যেতে পারলেন না তার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন অতি আদরের উত্তরসূরি মেসির হাতে কাপ জয়ের এই আনন্দঘন দৃশ্যটি। বেঁচে থাকলে নিঃসন্দেহে এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দে ভাসতেন ম্যারডোনাই। তবে হয়তো বা সেটা বুঝতে পেরেই টুর্নামেন্টের শুরুতেই জোরালো প্রত্যাশায় মেসির ঘোষণা ছিল, “ম্যারডোনার জন্যই আমরা এবার কাপ জিততে চাই”।

বিশ্ব ফুটবলে যুগ যুগ ধরেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ মানেই মহারণ। এই ম্যাচকে কেন্দ্র করে পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্তের সৃষ্টি করে চরম উত্তেজনাকর এক পরিবেশ। বিষয়টি রূপ নেয় অনেকটাই অঘোষিত এক বিশ্বযুদ্ধে। ঠিক তেমনটিই ঘটেছিল এবারের কোপার ফাইনালকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব ফুটবলের বড় আসরগুলোর ফাইনাল মানেই দুই দলের উপর অতিরিক্ত স্নায়ুর চাপ। যে কারণে অধিকাংশ ফাইনাল ম্যাচই খেলার মান দিয়ে মন ভরাতে পরেনা দর্শকদের। কেবল জয়টাই এখানে থাকে মুখ্য। গতকালের ফাইনালেও অ্যাটাক-কাউন্টার অ্যাটাকের প্রত্যাশিত ঝলকানি পরিলক্ষিত হয়নি ততটা। তুলনামূলক বল কন্ট্রোল ও প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে আক্রমণের ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার চেয়ে এগিয়ে ছিল ব্রাজিল। এক গোলে পিছিয়ে পড়েও ব্রাজিল ম্যাচে ফেরার যে প্রাণান্তকর চেষ্টাগুলো করেছিল তা চীনের প্রচীরের মতো গোলপোস্ট আগলে রেখে বীরদর্পে প্রতিহত করে ব্রাজিলকে আর কোনো সুযোগই দেননি আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক মার্টিনেজ। যিনিই মূলত আর্জেন্টিনার এবারের কোপা জয়ের অন্যতম নায়ক।

এবারের কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফাইনালকে ঘিরে যেন ফিফা বিশ্বকাপের আবহই পরিলক্ষিত হয়েছে। অতীতে কোপার ৪২টি আসরে এমন আবহ দেখা যায়নি। এবারের ফাইনালে আরেকটি বিষয় ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়। অতীতের দীর্ঘ দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রেফারিদের পক্ষাপাতমূলক আচরণের বিষয়টি এবারেও গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল আর্জেন্টাইন সমর্থকদের। এটা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো কমতি ছিলো না তাদের। কিন্তু ফাইনালে উরুগুয়ের রেফারি এস্তেবান অস্তোইচের কঠোর এবং নিরপেক্ষ খেলা পরিচালনার ফলে সেই বিপদে এবার পড়তে হয়নি মেসির আর্জেন্টিনাকে।

এতদিন একটি আক্ষেপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল সময়ের সেরা তারকা মেসিকে- আর্জেন্টিনার জার্সিতে কিছু জিততে না পারা। এবারের কোপার আগে আলোকিত ক্যারিয়ারে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় চারবার ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সবক’টিই তিক্ততায় ভরা। নেই কোনও আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে এই ব্রাজিলের মাঠে প্রথম ট্রফি ছোঁয়া দূরত্বে থেকে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়েছিল মেসিকে, আর্জেন্টিনাকে। জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে মেসিরা পারেননি কোটি সমর্থকের মুখে হাসি ফোটাতে।

এই কোপা আমেরিকাতেই তিন তিনবার ফাইনালে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে মেসির। ২০০৭ সালে ভেনেজুয়েলার মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে ৩-০ গোলে হারে সেই স্বপ্নে বড় ধাক্কা খেতে হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে টানা দুটি কোপার ফাইনালে উঠে আবারও সমর্থকদের চরম হতাশ করেন। দুইবারই চিলির কাছে হেরে হয়েছে স্বপ্নভঙ্গ। সেই আক্ষেপ আজ ঘুচেছে। তা-ও ব্রাজিলের মাটিতে, ব্রাজিলের ফুটবলতীর্থ মারাকানায় নেইমারের ব্রাজিলকে হারিয়েই সেই আক্ষেপ ঘুচেছে আর্জেন্টিনার, মেসিরও।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Rakib Sarker ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
আমি একজন আর্জেন্টিনার সমর্থক তবে আমি বলবো ফুটবলেরই জয় হয়েছে ।আর খেলা শেষে মেসি ও নেইমার যেভাবে একে অপরকে আলিঙ্গন করেছে এটা দেখে সত্যিই খুবই ভালো লেগেছে । আর আমার দেশের কোনোকিছু অবুঝ সমর্থক কিছু না বুঝেই মারামারি-হাতাহাতি করে এসব দেখেও তাদের শেখা উচিত বোঝা উচিত
Total Reply(0)
Ataul Arif ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৭ এএম says : 0
আর্জেন্টিনা জিতেছে অভিনন্দন! তবে আজকে নেইমার এর খেলা এতটাই মুগ্ধ করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। এতদিন আমি নেইমারকে খুব একটা ভালো প্লেয়ার মনে হতোনা, আজ তাঁর খেলায় মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি।
Total Reply(0)
Rahman Mahabub ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৮ এএম says : 0
Normally ja team goal khay tara 2nd helf a vlo khala..karon tara presure a thaka.. Overall Argentine vlo khalca.
Total Reply(0)
Apu Sarker ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৯ এএম says : 0
হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের ট্রল থেকে বিরত থাকুন ১টি ট্রল হতে পারে সারাজীবনের কান্না। শুধু সমবেদনা
Total Reply(0)
এম.এন কবির ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৯ এএম says : 0
গত ১৫ বছরে ব্রাজিল কয়টা ফাইনাল খেলেছে। জয়পরাজয় খেলায় হয়,যে কোন প্রতিযোগিতায় হায়।
Total Reply(0)
Saiful Islam ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৫০ এএম says : 0
দুর্ভিক্ষের সময় একটা রুটি পেলে আর ২৮ বছর পর কাপ এর দেখা পেলে এমনই করে।
Total Reply(0)
Zakir Hossain ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৫০ এএম says : 0
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খেলোয়ার মেসির জন্য এই কাপটা দরকার ছিল
Total Reply(0)
Z. R Jwel ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৫১ এএম says : 0
আসুন সব বিবেদ ভুলে গিয়ে আমরা সবাই মিলে মিশে একসঙ্গে তাকি খেলা মানে হার জিতে সংসার
Total Reply(0)
Ahmed Shamol ১২ জুলাই, ২০২১, ১২:৫২ এএম says : 0
নেইমারের কান্না দেখে মনে হয়েছে কাপটি নেইমারকে দিয়ে দেই।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন