ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়ককে বলা হয়ে থাকে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে পণ্য ঢাকায় আনা-নেয়া করেই অর্থনীতিকে সজল রাখা হয়। সেই লাইফ লাইনে গতকাল সকালে প্রায় ২০০ কিলোমিটার যানজট ছিল। দিনের মধ্যভাগে যানবাহন ঘণ্টা ২ থেকে ৫ কিলোমিটার গতিবেগে চলেছে। মহাসড়কে যানজট কমাতে কাঁচপুর থেকে বিকল্প পথ ভুলতা-নরসিংদী-ভৈরব ব্রিজ-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে দুপুরের পর যানজট কিছুটা কমলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যানজট রয়ে গেছে। করোনা মহামারির মধ্যেই মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহার উপলক্ষ্যে ৮ দিনের জন্য লকডাউন শিথিল করা হয়। এই শিথিলের আগেই অর্থনীতির লাইফ লাইনের এই ভয়াবহ যানজটের চিত্র হলে ঈদের ৭ দিন কি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে সংস্কার ও সেতু মেরামতের কাজ চলার কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে সড়ক সংস্কার ও সেতু মেরামত প্রশংসনীয় উদ্যোগ; কিন্তু জেনে বুঝে ঈদের আগে কেন সংস্কার? ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঈদের সময় সড়ক সচল রাখতে তারা মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে সংস্কার কাজ স্থগিত রাখার ব্যবস্থা করেননি।
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত সূত্রধর ইনকিলাবকে বলেন, লাঙ্গলবন্দর ব্রিজের মেরামতের কাজ চলছে। এ জন্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বন্ধ রাখা হয়। সেই কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক লেনে গাড়ি চলাচল করেছিল। সে জন্য কিছু সময় যানজট হয়। তবে মেরামত কাজ শেষ হওয়ার পর যানজট কমে যান। বর্তমানে নির্বিঘ্নে গাড়ি চলাচল করছে। তিনি আরো জানান, সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইন বোর্ড থেকে শুরু করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা-গাউছিয়া অংশ হাইওয়ে পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য চট্টগ্রাম রোডে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভুলতায়ও আরেকটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সেখানেও আমাদের জনবল রয়েছে। ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের প্রতিটি পয়েন্টে হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও মহাসড়কে জরুরি মোবাইল টিম থাকবে। ঈদে গাড়ির চাপ যতই থাকুক না কেন, আশা করি যানজট হবে না। ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কেই গাড়িগুলো নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেই পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে লকডাউন শিথিল ঘোষণা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেই ‘শিথিল’ সময় আসার আগের দিনই রাস্তায় নেমে পড়ে শত শত যানবাহন আর হাজার হাজার মানুষ। ফলে লকডাউন খোলার আগেই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে সংযোগ রক্ষাকারী মহাসড়কগুলোতে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২০০ কিলোমিটার, ঢাকা টু বগুড়া শহরে ৩০ কিলোমিটার, ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়ক, ঢাকা টু ময়মনসিংহ সড়ক ব্যাপক যানজট লেগে যায়। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন খোলার আগেই এই চিত্র। লকডাউন শিথিল হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর হাটে গরু আনা-নেয়া শুরু এবং দূরপাল্লার গণপরিবহন পুরোপরি চালু হলে সড়কগুলোর কি চিত্র ধারণ করতে পারে তা বোঝা যাচ্ছে।
ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রামে ফিরতে সড়ক-মহাসড়কে মানুষের ঢল দেখা গেছে। কিন্তু ঈদের আগে রাস্তা ও ব্রিজ সংস্কার করতে হবে কেন? ঈদুল ফিতরে সড়ক মহাসড়কে জনসমাগম বেড়ে যায়, সেটা কি নতুন কিছু? ঢাকা টু চট্টগ্রাম মহাসড়কে একপাশের যানবাহন বন্ধ রেখে অন্য যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ফলে লেগে যাচ্ছে যানজট। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেঢালা মনোভাবে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানারও বালাই দেখা যাচ্ছে না। ঈদ উপলক্ষ্যে গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হবে। গার্মেন্টসের কর্মীদের বেতন বোনাস দেয়া হলেও তারা গ্রামের দিকে ছুটবেন। কারণ লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলেও গার্মেন্টস খোলা ছিল। তাছাড়া যারা গার্মেন্টসে কাজ করেন, তারা প্রায় সকলেই নিম্নআয়ের পরিবারের সদস্য। রাজধানীর আশপাশে তারা নিম্নমানের মেসবাড়িতে থাকেন। ফলে তারা ঈদ করবেন নিজ গ্রামের পরিবারের সঙ্গে। এই শ্রমিকরা গ্রামের পানে ছুটলে সড়ক মহাসড়কের যানজট কোনো পর্যায়ে চলে যায় বলা কঠিন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২০০ কিমি. যানজট
রাজধানী ঢাকা টু বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মহাসড়ককে অর্থনীতির পাইপ লাইন বলা হয়। লকডাউন শিথিল হওয়ার আগেই গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকার কাছাকাছি পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার সড়কে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল হাজার হাজার পণ্যবাহী যানবাহন। কিছু সময় পর পর ২/৩ কিলোমিটার গতিতে থেমে থেমে চলতে দেখা গেছে। গত দু’দিন ধরে চলছে এই অবস্থা। মহাসড়কজুড়ে হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের সারি।
জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ও মেঘনা সেতুর মাঝামাঝি লাঙ্গলবন্ধ সেতুর ক্ষতিগ্রস্ত ডেক সø্যাব মেরামত কাজ চলছে। সে কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানবাহন ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে চলাচলের নির্দেশনা দেয়া হয়। গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যানবাহনগুলো শুধু সেতুর একপাশ দিয়ে চলাচল এবং রাত ১০টার পর থেকে বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত সেতুর ওপর দিয়ে পুরোপুরি যানবাহন চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। বিকল্প পথ হিসেবে হালকা যানবাহনগুলোকে মোগড়াপাড়া-কাইকারটেক ব্রিজ-নবীগঞ্জ-মদনপুর সড়ক এবং ভারি যানবাহনগুলোকে কাঁচপুর-ভুলতা-নরসিংদী-ভৈরব ব্রিজ-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা সড়ক ব্যবহার করতে বলা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর গুঞ্জন দে জানান, থেমে থেমে গাড়ি চলছে। কখনও ২/৩ কিলোমিটার, কখনো ২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলছে। একেবারে থেমে নেই। ৪ লেন হাইওয়ের গাড়ি এই এক লেন সড়ক দিয়ে চলছে। সঙ্গত কারণে কুমিল্লা-সিলেট সড়কে বড় ধরনের লোড পড়েছে। তাছাড়া সিলেট হাইওয়ের গাড়িও আছে।
এদিকে বন্দর (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর মোগরাপাড়া এলাকায় দুইপাশ বন্ধ করে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর লাঙ্গলবন্দ সেতু মেরামত কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ। টানা দুদিনে ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইওয়ে আটকা পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, লাশবাহী ও পণ্যবাহীসহ হাজার হাজার যানবাহন। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী ইকবাল বলেন, সওজের পক্ষ থেকে নোটিশ দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সবধরনের যানবাহনকে বিকল্প পথ ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু যানবাহনের চালকরা বিকল্প পথ ব্যবহার না করার কারণে মহাসড়কে আজ ভোররাত থেকে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক মো. মনির আহম্মেদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, লাঙ্গলবন্দ সেতুর সংস্কারকাজ করায় এই যানজটের সৃষ্টি। তবে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছেন যানজট নিরসনের জন্য। আশা করছি, সন্ধ্যা নাগাদ যানবাহনের চাপ কমে যাবে। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লাঙ্গলবন্ধ সেতু মেরামতের কারণে একপাশ বন্ধ থাকায় ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কজুড়ে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, লাঙ্গলবন্দ সেতুর মেরামত কাজ চলবে, এই মর্মে সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করলেও প্রবেশ পথগুলোতে নিয়োজিত পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে মূলত যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় পথে পুলিশের ব্যারিকেড না থাকায় উল্টো পথে যানবাহন প্রবেশে করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে মহাসড়কের ওপর হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
শিমুলিয়া ঘাটে মানুষের ঢল :
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে চলমান লকডাউন বৃহস্পতিবার থেকে শিথিলের ঘোষণা দেয়ার পর বুধবার সকাল থেকেই লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাটে ঢাকা ও ঘরমুখী মানুষের ভিড় বেড়েছে। গত দুই সপ্তাহে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী মানুষের চাপ ছিল। কিন্তু গতকাল ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাগুলোতেও মানুষ ছুটছে। গতকাল বুধবার শিমুলিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উভয়মুখী যাত্রীর অনেক চাপ। যাত্রীরা জানিয়েছেন, চেকপোস্টগুলোতে আগের মতো কড়াকড়ি তথা কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ও বাধা ছাড়াই ঘাটে আসছে যাত্রীরা। বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ জানান, এ নৌরুটে ছোট-বড় ১১টি ফেরিতে গাড়ি পারাপার হচ্ছে। শিমুলিয়া ঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক জাকির হোসেন জানান, কাল থেকে লকডাউন শিথিল হলেও আজ থেকেই ঘাটে চাপ দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, পার্কিং ইয়ার্ডে দুই শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাটের ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট (টিএস) মেহেদী হাসান জানান, লকডাউন শিথিল হচ্ছে। এ কারণে হয়তো চেকপোস্টে কড়াকড়ি কমে গেছে। আর সেজন্য আজ ঘাটে উভয়মুখী যাত্রীর চাপ বেড়েছে।
গাজীপুরে সড়ক অবরোধ
এমনিতেই সড়কে যানজট তার মধ্যেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের লক্ষ্মীপুরা এলাকায় বেতন-বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করে সড়ক অবরোধ করে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। গতকাল বুধবার সকালে সড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ করেন। এতে জয়দেবপুর-ঢাকা সড়কের দুইপাশে পণ্যবাহী যানবাহনের জট তৈরি হয়েছে।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, লক্ষ্মীপুরা এলাকার স্টাইল ক্র্যাফট লিমিটেড নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে ৭০০ জন কর্মী। কয়েক বছর ধরে কারখানাটিতে বেতন অনিয়মিত। এভাবে কর্মীদের চলতি বছরের তিন মাসের এবং এর আগের দুই বছরের চার মাসের বেতন বকেয়া আছে। গত রোজার ঈদের আগেও আন্দোলন করে বেতন ও বোনাস নিতে হয়েছে কারখানার শ্রমিক-কর্মীদের। ঈদ উপলক্ষ্যে কাজ বন্ধ করা হলে কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যার মধ্যে টাকা দেওয়ার সময় দেয়। বেতন-বোনাস দেওয়া হয়নি। শ্রমিক ও কর্মীরা কাজ বন্ধ করে কারখানার ভেতরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা কারখানার সামনে জয়দেবপুর-ঢাকা সড়কে অবস্থান অবরোধ সৃষ্টি করেন। এতে দুই পাশে পণ্যবাহী যানবাহনের জট তৈরি হয়। গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, শ্রমিক ও কর্মীরা বেতন পাচ্ছেন না। বেতনের দাবিতে তারা সড়কে অবস্থান নেন। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন