শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারত-পাকিস্তানকে সংযমী হতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
ভারত-পাকিস্তানের কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের সামরিক সাজসজ্জা ও লড়াচড়া দেখে পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশ দুটি সংক্ষিপ্ত কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের দিকেই যেন এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই জোরদার হওয়ার পাশাপাশি সামরিক লড়াইয়ের প্রস্তুতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রোববার কাশ্মীরের উরির সেনাক্যাম্পে হামলায় ১৭ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজানো হচ্ছে “যুদ্ধের দামামা”। ভারতের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কঠোর জবাব দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু পাকিস্তান ভারতের এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলে, কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক। দুই দেশই আক্রমণাত্মক আচারণ নীতি অবলম্বন করেছে। এই কঠিন পরিস্থিতর মধ্যে ভারত ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফাল মডেলের যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি সই করেছে।
এদিকে ২৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান রাশিয়ার সাথে ইতিহাসের এই প্রথম যৌথ সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। যেমন কথা তেমন কাজ। ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পাকিস্তানে মহড়ার উদ্দেশ্যে পৌঁছেছে রুশ বাহিনী এবং মহাসড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সেখানে যুদ্ধবিমানের ওঠানামা করানো হচ্ছে। তবে পাকিস্তান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ দাবি করলেও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ায় ভারত এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রাচীন ইতিহাসের শিক্ষার পীঠস্থানকে ‘সন্ত্রাসের আখড়া’ বানিয়েছে পাকিস্তান।
জাতিসংঘের ভারতীয় মিশন বিবৃতিতে বলেছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশি সাহায্য ব্যয় করে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। তবে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের চেয়ে ভারতের মিডিয়া যুদ্ধের দামামার মাতন দিচ্ছে। ভারতের মিডিয়া সেনাবাহিনীর চেয়ে এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার একটি জনপ্রিয় সংবাদভিত্তিক ইংরেজি টেলিভিশনের চ্যানেলের উপস্থাপক অর্ণব গোস্বামী পাকিস্তানকে উদ্দেশ করে বলেছেনÑ ‘আমাদের উচিত পাকিস্তানকে পঙ্গু করে দেয়।’ এ ছাড়াও ভারতের একটি সংবাদ মাধ্যম গত বুধবার তাদের একটি প্রতিবেদনে শিরোনাম করেছে ‘সেনাবাহিনীর কী দরকার, ভারতের মিডিয়া তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।’
পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেবার হুমকি দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলেছেন, গুরুত্বর্পূ প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের ভূখ-ে পাল্টা আঘাত হানার জন্য ভারতের সামর্থ্য এবং গোয়েন্দা তথ্য আছে কিনা? ভারতের জন্য এটা সহজ হবে না। কারণ পাকিস্তানের রয়েছে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অন্যদিকে ভারতে এমন অভিমতও আছে যে, এ মুহূর্তে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সমীচীন হবে না। এ জন্য আরো প্রস্তুতির প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। তবে ভারত যত বড়ই হুমকি দেক না কেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ বলেছেন, তার বাহিনী যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে।
কাশ্মীর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাকে বিশ^নেতারা উপেক্ষা করেছেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে নওয়াজ শরিফ বলেছেন, ভারত বিপুল অস্ত্র ভা-ার গড়ে তুলেছে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সব কিছু পাকিস্তান করবে বলে পাক প্রধানমন্ত্রী জানান।
টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে ভারতের কোথায় কোথায় হামলা করা হবে তার লক্ষ্যবস্তু ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করে রেখেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। অন্যদিকে গত বুধবার ভারত ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফাল মডেলের যুদ্ধ বিমান কেনার যে চুক্তি সই করেছে, জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী ৩৬টি যুদ্ধবিমান কিনতে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৮ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করবে ভারত সরকার। দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানগুলো ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শত্রু বিমানে ক্রুস মিসাইলের মাধ্যমে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে যুদ্ধবিমানের প্রথম চালনটি ভারতে আসতে দেড় বছর সময় লাগবে বলেও জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যমটি।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার পাকিস্তান মহড়ার উদ্দেশ্যে এসে পৌঁছেছে রুশ সেনাবাহিনীর একটি টিম। দিল্লির পক্ষ থেকে সম্প্রতি এই মহড়া বাতিলের জন্য মস্কোর কাছে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল মস্কো। এদিকে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের আইএসপিআর জানিয়েছে, ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে মহড়া চলবে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই মিত্রতা আর আগের মতো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ভারতমুখী হয়ে যাওয়ায় দুই দেশের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন চলছে। বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত। কাশ্মীর জ¦লছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। সর্বত্রই বারুতের গন্ধ। পুড়ছে ঘরবাড়ি, মাঠঘাট, শহর-বন্দর। বিবর্ণ হয়ে উঠেছে ভূ-স্বর্গের মাটি। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও নির্বিচার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো জোরালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাশ্মীর নীতি বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এখন আর সেই অবস্থায় আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, হরি সিং ১৯২৫ সালে কাশ্মীরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা চলে যাওয়ার সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর পাকিস্তান সমর্থিত আদিবাসীরা হরি সিং লর্ড মাউন্ড ব্যাটনের মধ্যস্থতায় ১৯৪৭ সালের ২৫ অক্টোবর কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। বিরোধের সূত্রপাত এখান থেকেই।
১৯৪৭ সালে বৃটিশরা চলে যাওয়ার সময় কাশ্মীরি জনগণ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এ নিয়ে ’৪৭-৪৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালেও দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই দুই যুদ্ধ কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। নেহেরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এই ইস্যু ভারতের তরফে জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়া হয়। জাতিসংঘ এর সমাধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারত এই গণভোট দেয়নি।
মুসলমানদের আধিক্য থাকার পরও হরি সং এর কারণে দুই ভাগ হলো কাশ্মীর। আজাদ কাশ্মীর ও জম্মু কাশ্মীর। আজাদ কাশ্মীর আন্তর্জাতিক মহলের কাছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হিসেবে পরিচিত। বাকি অংশ ভারত নিয়ন্ত্রিত। পাকিস্তানের দাবি আজাদ কাশ্মীর স্বাধীন দেশ আর জম্মু ভারতের দাবি অনুযায়ী তাদের রাজ্য। জম্মু নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। যত বিতর্ক কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকা নিয়ে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরের উরিতে সেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ ছিল বলে স্বীকার করেছেন ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনহর পরিকর। আর এই ঘাঁটিতে ১৭ সেনা সদস্য নিহত হওয়ার পর দিল্লির নীতিনির্ধারকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। দিল্লির ভয় হলো কাশ্মীরের দাবি মেনে নিলে ভারতের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে, এমনকি ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়া হওয়ার ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। সে শঙ্কা থেকেই নিষ্ঠুর নীতি গ্রহণ করেছে ভারত। অথচ কয়েক দিন আগে কাশ্মীরের দায়িত্ব পালনরত ভারতের আর্মির সর্বোচ্চ কমান্ডার লে. জেনারেল হুদা বলেছেন, কাশ্মীর সমস্যা বন্দুকের নল দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। এটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।
প্রশ্ন হলোÑ কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে লে. জেনারেল হুদা, নোয়াম চমস্কি, অরুন্ধতী রায়সহ বিভিন্ন সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য মত ব্যক্ত করেছেন। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেন তা বুঝতে পারছেন না?
এই উপমহাদেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধপরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তাদের যুদ্ধ বা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠা উচিত হবে না। এতে শুধু দেশ দুটিই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে না বরং প্রতিবেশী দেশগুলোও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, একে অপরকে দোষারোপ না করে পরস্পরের প্রতি যেসব অভিযোগ রয়েছে তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
কাশ্মীরে ভারতের হত্যা-নির্যাতন, দমন-দলন অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় নেতাদের এই সত্য ও বাস্তবতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। সমস্যার একমাত্র সমাধান জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরি জগণের হাতে ছেড়ে দেয়া। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ভিন্ন কোনো পথে সম্ভব নয়। কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়ে গেলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উন্নতি ঘটবে। ফলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, সমৃদ্ধির নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আমি বিশ^াস করি। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হোক এটাই উপমহাদেশের জনগণের প্রত্যাশা।
ষ লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন