ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা অনুমোদনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জেজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালত এ অনুমোদন দেন। এর আগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পরপর প্রতিষ্ঠানটির দুই শীর্ষ কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অনুসন্ধান পর্যায়ে জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুদকের ইতোপূর্বে দেয়া নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করেছেন আদালত। গতকাল এ তথ্য জানান দুদকের কোর্ট পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, অনুসন্ধান পর্যায়ে গত ৯ জুলাই তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুদক। পরে নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন নিতে গত ১৫ জুলাই আদালতে আবেদন করে। মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ আবেদনটি মঞ্জুর করেন।
উল্লেখ্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ইভ্যালির অনিয়ম অনুসন্ধানে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটিতে একজন সহকারী পরিচালক ও উপ-সহকারী পরিচালককে সদস্য করা হয়। পরে গ্রাহক ও মার্চেন্টের ৩৩৯ কোটি টাকার হদিস না থাকার বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। একইসঙ্গে সার্বিক অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে শঙ্কায় ইভ্যালির এমডি মো. রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় সংস্থাটি। এদিকে, ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (মার্চেন্ট) কেউ কেউ গ্রাহকেদের পণ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ইভ্যালির দেয়া ভাউচার দিলেও প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের বলছে ইভ্যালির কাছ থেকে পণ্য বুঝে নিতে। কারণ ভাউচারের বিপরীতে ইভ্যালি তাদের পাওনা পরিশোধ করেনি। এছাড়া ইভ্যালিসহ বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করেছে কয়েকটি ব্যাংক।
এদিকে দুদক সূত্র জানায়, ইভ্যালি তার গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে অগ্রিম হিসাবে নেয়া অন্তত ৩৩৯ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেলো গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া এই অর্থ সেটি অনুসন্ধানে কাজ করছে দুই সদস্যের দুদক টিম। সহকারি পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন টিম শিগগিরই ইভ্যালির দুই কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিয়েছে। এর আগে গত ৪ জুলাই ইভ্যালির বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের চার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
দুদক জানায়, চলতি বছর ১৪ মার্চ ইভ্যালির মোট সম্পদ ছিলো ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা)। মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা। ওই তারিখে গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টদের কাছ থেকে ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকার মালামাল নেয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ৯১৪ টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা।
ইভ্যালি তাদের চলতি সম্পদ দিয়ে মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বা অর্থ ফেরত দিতে পারবে। বাকি গ্রাহক এবং মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক ও মার্চেন্টের কাছ থেকে গৃহিত ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
চলতি বছর জুন মাসে ইভ্যালি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ সদস্যের পরিদর্শন টিমের তৈরি গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ইভ্যালির নিট লোকসানের পরিমাণ ৩১৬ কোটি টাকার বেশি। শেয়ার মূলধনের ২শ’ গুণেরও বেশি হারে লোকসান হচ্ছে। তা সত্ত্বেও কোম্পানিটির এমডি ও চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতনরা মাসে ১৮ লাখ টাকা বেতন নিচ্ছেন।
সূত্রমতে, ২০২১ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটির পুঞ্জিভূত নিট লোকসানের পরিমাণ ৩১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৬ হাজার ১৪৮ টাকা। কোনো কোম্পানির লোকসান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া এবং মোট সম্পদের দ্বিগুণের অধিক ও শেয়ার মূলধনের দুইশ’ গুণেরও অধিক হারে লোকসান হওয়া কোম্পানিটির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি আর্থিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম ঘাটতিকেই নির্দেশ করে। অদূর ভবিষ্যতে এই বিপুল পরিমাণ লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানির অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন