সোহাগ খান : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ১০ টাকায় খোলা ৯১ লাখ হিসাবে পুঞ্জীভূত টাকার পরিমাণ মাত্র ২০০ কোটি। এই হিসাবগুলোর মাঝে সচল রয়েছে মাত্র ১৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০টি। তাও আবার সরকারী ভর্তুকি, রেমিটেন্স বা বেতন উত্তোলন ছাড়া অন্য কোন লেনদেন এ সকল হিসাবে হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ সকল ব্যাংক হিসাব সচল রাখার জন্য সরকার ২০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে।
এই তহবিল থেকে কৃষকদের সহজ-শর্তে ঋণ দেয়ার কড়া নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না মাঠ পর্যায়ের ব্যাংক কর্মকর্তারা। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার প্রান্তিক চাষী ঈসমাইল হোসেনের অগ্রণী ব্যাংক সাঘাটা শাখায় ১০ টাকার হিসাবটি এখনও সচল। তিনি শুধুমাত্র কৃষি ভর্তুকির টাকা উত্তোলন ছাড়া এই শাখায় কখনও যান নি। চলতি বছরের প্রথমে ২০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন সুবিধার কথা পত্রিকায় পড়ে সাঘাটা শাখায় ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য গেলে তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুল মান্নান তাকে জানান, এ সকল ফান্ড শুধু পত্রিকায় থাকে। শাখায় এ সকল ফান্ডের টাকা এসে পৌঁছায় না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ৪০ হাজার কৃষক সরকারী ভর্তুকি পেয়েছে। তাদের হিসাবে সরকারী জমা আছে ২১ কোটি টাকা। বেতন বাবদ লেনদেনকৃত হিসাবসমূহে জমা আছে ৩১ কোটি টাকা। আর ১৬ হাজার ৬৫ জনের হিসাবে রেমিটেন্স লেনদেন হয়েছে। রেমিটেন্স লেনদেনকৃত হিসাবসমূহে সর্বোচ্চ জমা আছে ৩৬ কোটি টাকা।
কৃষি কর্মকা-ে সরকারী সহায়তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং প্রান্তিক জনগণকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান ১০ টাকার হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়। যাতে দেশ-বিদেশে তিনি ব্যাপক প্রশংসা পান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দেশনা অনুযায়ী সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক চাষীদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় তফসিলী ব্যাংকগুলো ১০ টাকা হিসাব খোলা শুরু করে। পরে মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, বয়স্কভাতা, বিভিন্ন প্রান্তিক লোকজন এই হিসাব খোলার সুযোগ পান। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, কৃষি সহায়তার কার্ড নিয়ে এ সকল হিসাব খোলা গেলেও ন্যূনতম স্থিতি রাখার কোন নিয়ম ছিল না। যার ফলে এ সকল হিসাব এখন অব্যবহৃত হিসাবে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে।
৯০ ভাগ হিসাবে বছরে একবারও লেনদেন হয় না বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন শাখা ব্যবস্থাপকরা। অভিযোগ রয়েছে, মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণার অভাবে দেশে এক কোটি প্রান্তিক হিসাব অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। যা শাখা ব্যবস্থাপকদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রূপালী ব্যাংক গাইবান্ধা শাখার ব্যবস্থাপক খাইরুল হাসান সোহেল বলেন, যে সকল হিসাবে কোন অর্থ থাকে না, তা নিয়ম অনুযায়ী আমরা বন্ধ করে দেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা থাকায় শাখার জন্য কষ্ট হলেও অর্থশূন্য প্রায় ৪ হাজার হিসাব গত দু’বছর ধরে আমরা টেনে যাচ্ছি। মাঝে ভর্তুকির সময় কিছু লোকজন এসছে, এখন আবার শূন্য অবস্থা। এক প্রকার গোদার উপর বিষফোড়া বলতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষকদের জোর করে ঋণ দেয়া বা সঞ্চয় করানো যাবে না। এ বিষয়ে তাদের সহজ ধারণা দিতে পারলেই তারা নিজ থেকে ঋণ বা সঞ্চয় করতে আগ্রহী হবে। এ জন্য মাঠ পর্যায়ের ব্যাংক কর্মকর্তাদের সরাসরি কৃষকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। তখন কৃষকদের হিসাবে সঞ্চয় বা লেনদেন দুটোই বাড়বে।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক জনগণকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতেই ১০ টাকা হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটা নি:সন্দেহে ভালো উদ্যোগ ছিল। এক কোটি হিসাবে ২০০ কোটি টাকা জমা আছে, এটা হাস্যকর কোন বিষয় নয়। তবে অনেক ব্যাংক হিসাব অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে এটাই চিন্তার বিষয়।
তিনি বলেন, প্রান্তিক হিসাবগুলোকে সচল রাখতে হলে অবশ্যই ব্যাংকারদের কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনের সাথে মিশে যেতে হবে। তাদের ব্যাংকিং-এর সুফল বুঝাতে হবে। তবেই এ সকল ব্যাংক হিসাব তাদের বোঝা না হয়ে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে। এক কোটি হিসাবে দৈনিক ১০০ টাকা করে জমানো শিখাতে পারলে বছরে কত কোটি টাকা দাঁড়াবে এ সকল হিসাবে একবার কল্পনা করুন। তাই প্রান্তিক ব্যাংক হিসাবসমূহকে বোঝা না ভেবে ব্যাংকগুলোর উচিত প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়ে এ সকল হিসাবকে সচল করার উদ্যোগ নেয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন