বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বস্তিতে একে-২২ রাইফেল

প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি , উৎস অজানা
রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে এবার বস্তিতে পাওয়া গেল ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র একে-২২ রাইফেল। এ নিয়ে গত দুই বছরে এ ধরনের ১৫টি সেমি অটোমেটিক রাইফেল ধরা পড়ল। নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে রেলওয়ের বাস্তুহারা কলোনি (বস্তি) থেকে একটি একে-২২ রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব। গতকাল (মঙ্গলবার) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
বস্তিতে একে-২২ রাইফেলের মতো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সেখান থেকে একটি বন্দুক, দু’টি ম্যাগজিন, ১৬টি রকেট প্লেয়ারও উদ্ধার করা হয়। কারা এসব অস্ত্র সেখানে মজুদ করেছে তাৎক্ষণিক তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি কোনো সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠীর গোপন আস্তানা কি না তা নিশ্চিত হতে তদন্ত অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে জানান র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ।
মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত বাস্তুহারা কলোনি ঘিরে গতকাল সকালে অভিযান শুরু করে র‌্যাবের একটি বিশাল টিম। অভিযানের একপর্যায়ে সেখান থেকে উদ্ধার হয় এসব আগ্নেয়াস্ত্র। মাদকের আখড়া হিসেবে পরিচিত এই বস্তি আগে থেকেই র‌্যাবের নজরদারিতে ছিল। মূলত মাদক উদ্ধারেই সেখানে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে একটি একে-২২ রাইফেল, একটি বন্দুক, দুটি ম্যাগজিন, ১৬টি রকেট প্লেয়ার ও চারটি রামদা রয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইজনকে আটক করেছে র‌্যাব।
অভিযান শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে ওই বস্তির দু’টি ঘরের লোকজন পালিয়ে যায়। ওই এলাকার একটি সরু রাস্তা ও ড্রেনের পাশ থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের কাছে বড় এলাকা নিয়ে ওই বস্তিতে পাঁচ হাজারের মতো ঘর রয়েছে। সেখানে ঘর ভাড়া নিতে কারো পরিচয়পত্র দেখাতে হয় না। ফলে সেখানে সহজেই আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন এই র‌্যাব কর্মকর্তা।
গত বছর জঙ্গিগোষ্ঠী হামজা ব্রিগেড এবং সম্প্রতি ঢাকায় জঙ্গিদের কাছে একে-২২ রাইফেল পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানেও উদ্ধার হওয়া রাইফেলের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসূত্র আছে কি নাÑ আমরা তা তদন্ত করছি। ওই দুই ঘরের বাসিন্দারের পরিচয় জানা না গেলেও পাশের দু’টি ঘরের দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে মিফতাহ উদ্দিন জানান।
তিনি বলেন, দুই ঘণ্টা ধরে এই বস্তির বিভিন্ন ঘরে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় দু’টি ঘর থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা এই দুই ঘরের মালিককে আটক করেছি। আমাদের ধারণা, জঙ্গিরা অভিযানের বিষয়ে টের পেয়ে অস্ত্রগুলো রেখে পালিয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারের বিষয়ে অভিযান অব্যাহত আছে।
এদিকে র‌্যাব অস্ত্রগুলো জঙ্গিগোষ্ঠীর ধারণা করলেও বস্তিবাসীরা মনে করছেন, এগুলো মাদকব্যবসায়ীদের। তারা রুহুল আমিন, মুক্তার, রফিক ও বাবুলসহ বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর নাম বলছিলেন র‌্যাব কর্মকর্তাদের কাছে। এই মাদক ব্যবসায়ীরা প্রায় সময়ই বস্তিতে বাস করা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতো এবং তাদের জিনিসপত্র লুট করত বলে অভিযোগ করেছেন সবাই। পাশাপাশি প্রায় সময় বস্তিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেন এই মাদক ব্যবসায়ীরাÑ এমনও জানালেন বস্তির বাসিন্দারা।
এদিকে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়িতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ নিয়ে গত দেড় বছরে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলা থেকে অন্তত ১৫টি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ-জেএমবি এবং নবগঠিত জঙ্গি সংগঠন হামজা ব্রিগেড কমান্ডের আস্তানা থেকেও একাধিক একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকেও মিলেছে ভয়ঙ্কর এ সমরাস্ত্র।
একের পর এক এ ধরনের ভারী অস্ত্র উদ্ধার হলেও এর উৎস অজানা থেকে যাচ্ছে। সীমান্ত পার হয়ে এসব আগ্নেয়াস্ত্র দেশে আসছে। তবে কারা এসব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসছে তাদের সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এ পর্যন্ত যতগুলো একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়েছে মামলা তদন্ত শেষে অস্ত্রসহ গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তবে যাদের হাত ধরে এসব আগ্নেয়াস্ত্র সীমান্ত পার হয়ে এসেছে তাদের কাউকেই চিহ্নিত কিংবা পাকড়াও করা যায়নি।
আন্ডারওয়ার্ল্ডে বহুল ব্যবহারের কারণে চট্টগ্রামে একসময় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল একে-৪৭ ও এর চায়নিজ সংস্করণ একে-৫৬ রাইফেল, একে-১৬ ও নাইন শুটারগান। বিগত দিনে এ ধরনের অসংখ্য ভারী অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে একে-২২ নামক রাইফেলটি একে ৪৭-এর স্থান দখল করে নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে আসায় এ নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
জানা যায়, একে-৪৭ রাইফেলের পরবর্তী সংস্করণ একে-২২ রাইফেল। দু’টি রাইফেল দেখতে অনেকটা একইরকম হলেও পার্থক্য হলো একে-২২ আকারে ছোট। আর এ কারণেই সন্ত্রাসীদের কাছে কদর বেড়েছে অস্ত্রটির।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম একে-২২ রাইফেল ধরা পড়ে বান্দরবান এবং এরপর খাগড়াছড়িতে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নগরীর সদরঘাটে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের সময় একে-২২ রাইফেল ব্যবহার করে জেএমবির জঙ্গিরা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় দু’টি একে-২২ রাইফেল। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৩টি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। এর মধ্যে র‌্যাবের হাতে নয়টি, পুলিশের হাতে তিনটি ও সিআইডির হাতে একটি একে-২২ রাইফেল ধরা পড়ে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁশখালীর লটমনি পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক অস্ত্রের সাথে ৩টি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। একই বছরের ১৩ এপ্রিল পাঁচলাইশ থানার কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গি আস্তানা থেকে ৫টি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করে র‌্যাব। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্দ্বীপের হারামিয়া এলাকার সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা শাহেদ উল্যাহর কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক অস্ত্রের সাথে ১টি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়।
মহানগর পুলিশ গত ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম কলেজে অভিযান চালিয়ে স্টাফ কোয়ার্টারের পেছনে একটি গর্ত থেকে একটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করে। এছাড়া ১৯ এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া এলাকায় যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হক মাহফুজের (৪২) দেখানো মতে, একটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করে সিআইডি। একের পর এক অস্ত্র উদ্ধার হলেও এসব অস্ত্রের চোরাচালানের সাথে জড়িতদের শনাক্ত করা যায়নি। চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন আতঙ্কের নাম একে-২২ রাইফেল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন