বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনা সৌরশক্তিতে

প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সৌরশক্তি এখন সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্পখাতের উন্নয়ন ও প্রসার এবং নতুন টেকনোলজির এই বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা এখন অপরিহার্য। বিশ্ব বাজারে টিকে থাকার স্বার্থে দেশে সোলারের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৫০ লাখ পরিবারকে সোলার হোম সিস্টেমের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ ও ডিজেলের উপর চাপ কমাতে সেচ খাতেও সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
জানা যায়, গ্রীড টাইপ পদ্ধতিতে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা জাতীয় গ্রীডে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও বেসরকারি খাতে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা জাতীয় গ্রীডে যুক্ত করার মত সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি এখন বেক্সিমকো গ্রুপের। চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের (সিইইসি) সঙ্গে সোলার প্যানেল উৎপাদনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গাইবান্ধায় ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এই সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। এলক্ষ্যে কাজ চলছে। এ ব্যাপারে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বলেন, আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ছাদে ৮ মেগাওয়াটের সোলার প্যানেল স্থাপন করতে যাচ্ছি; যা হবে সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব। এছাড়াও গাইবান্ধায় ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন আরেকটি সোলার প্যানেল স্থাপন করা হবে। এখান থেকে উৎপাদিত সৌর বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হবে।
এদিকে, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেয়া এবং ঘনঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে শিল্পখাতকে রক্ষা ও কৃষিখাতে সেচ ব্যবস্থাকে সাশ্রয়ী করতে বিকল্প এই শক্তি নিয়ে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করছে ঠিকই; তবে সম্ভাবনাময় এই খাতের সম্প্রসারণে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশে বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালেও এর ভিত এখনও মজবুদ হয়নি। ফলে ২০২১ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ পৌঁছে দেয়ার সরকারি মহাপরিকল্পনা অনেকটাই হোঁচট খাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বিদ্যুতের উপর চাপ কমাতে ইজিবাইকের জন্য সরকার দেশের প্রথম সৌর স্টেশন চালু করেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এই চার্জিং স্টেশনটি স্থাপন করেছে। এই স্টেশন থেকে প্রাথমিকভাবে একসঙ্গে ২০ থেকে ২২টি ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেয়া যায়। এই সৌর চার্জ স্টেশনটি নির্মাণে আরইবি নিজস্ব তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছে। কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের সানি ফিলিং স্টেশনের ছাদের ওপর এটি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে কোন জমির প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র ফিলিং স্টেশনটির ছাদ ভাড়া নিয়ে স্টেশনটি স্থাপন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাদেশে যেভাবে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলছে; তাতে করে প্রচুর বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। এসব ইজিবাইকের ব্যাটারি যদি দেশের বিভিন্ন এলাকায় চার্জিং স্টেশন স্থাপন করে চার্জ করা হতোÑ তাহলে বিদ্যুতের অপচয় রোধ হতো। সেইসাথে গ্রামীণ এলাকায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণও কমে আসতো।
এদিকে, সম্প্রতি একনেক বৈঠকে চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং তিন পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ এবং উন্নয়ন সম্পর্কিত একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সৌর বিদ্যুৎ সরবরাহ কার্যক্রম চালু করা হবে। দুর্গম এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদে ‘সোলার বিদ্যুৎ সরবরাহ’ নিশ্চিত করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর।
বীর বাহাদুর ইনকিলাবকে বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মতে, এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলে পাহাড়ের প্রতিটি পাড়া ও গ্রাম আলোকিত হওয়ার পাশাপাশি ধান ভাঙানোসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরই বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সোলার এন্ড রিনওয়েবল এনার্জি এসোসিয়েশনের সভাপতি দীপাল চন্দ বড়–য়া ইনকিলাবকে বলেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) এর আওতাধীন ৫৮টি সংস্থা ৫০ লাখ পরিবারকে সোলার হোম সিস্টেমের আওতায় এনেছে। এছাড়াও গত ৩ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সোলার ইরিগেশন চালু হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ১৩ লাখ ডিজেল চালিত পাম্প রয়েছে। এসব পাম্প যদি দিনের আলোতে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চালানো যায়, তাহলে এসব পাম্পে ৮৭ ভাগ ডিজেলের ব্যবহার কমে যাবে। একইভাবে সেচ খরচও কমে যাবে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
দীপাল চন্দ বড়–য়া বলেন, বর্তমানে ২০০ মেগাওয়াটের উপর সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। তিনি এখাতের সম্ভাবনার পাশাপাশি সমস্যাগুলোও তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে বলেন, জমি পাওয়া এবং ঋণপ্রাপ্তিটা এক্ষেত্রে বড় সমস্যা। তিনি চায়না সোলার সাথে দেশীয় সোলারকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে ইডকল থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে।
অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের এক এনার্জি বিশেষজ্ঞ জানান, বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বিচ্ছিন্ন বসবাস, আঁকাবাঁকা নদ-নদীর কারণে গ্রীড বিদ্যুতায়ন বড়ই কঠিন ও ব্যয় বহুল। এসব এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য সোলার হাউজহোল্ড সিস্টেম (এসএইচএস) পদ্ধতিই সবচেয়ে উপযোগী। এই বিশেষজ্ঞর মতে, কেরোসিনের বাতির পরিবর্তে সোলার হাউসহোল্ড সিস্টেমের বাতি জ্বালানোর খরচ ৩৫ ভাগ সাশ্রয়ী হবে।
সরকারের নবায়নযোগ্য জ্বালানি কার্যক্রম থেকে জানা যায়, এই খাত থেকে সরকার ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৩১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। যার মধ্যে পাবলিক সেক্টর ১১শ’ মেগাওয়াট এবং বাকি অংশ বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারের এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে মার্চ, ২০১৬ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে মাত্র ৪৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছে। যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেকটাই কম।
সরকার দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ২০০৮ প্রণয়ন করেছে। এই নীতিমালায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির মূল উৎস হিসাবে সৌর শক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস, হাইড্রো, বায়ো ফুয়েল, জিও থার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে শনাক্ত করেছে। ঘোষিত এই নীতিমালা অনুযায়ী ২০২০ সাল এবং তার পরবর্তী বছরগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি হতে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপ ছাড়াও সোলার নিয়ে দেশে বেসরকারি খাতে যেসব কোম্পানি কাজ করছে তার মধ্যে রয়েছে- রহিম আফরোজের সোলার পিভি সিস্টেম, এলাইড সোলার এনার্জি লিমিটেড, ইনফ্রাস্ট্রাকসার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড (আইডিসিওএল), গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক সোলার, ইলেক্ট্রোকম টেকনোলজিস লিঃ, নেক্সট পাওয়ার লিঃ, ইনজেন টেকনোলজি লিমিটেড, ফুজিতসু বাংলাদেশ লিমিটেড, ইনোভেটিভ টেকনোলজি, ইকো পাওয়ার কোম্পানী লিমিটেড (ইপিসিএল), আভা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, সোলার প্যাক, সোলার বাংলাদেশ, সনোস এনার্জি সেভিং টেকনোলজি, ঢাকা সার্ভিস কোম্পানী, ব্রাইট ইলেক্ট্রিক সেভার টেকনোলজি লিঃ, গ্রীন এনার্জি সলিউশন লিঃ, উত্তরণ টেকনোলজি, ডিজিটাল টেকনোলজি ও আকাশ সোলার এনার্জি লিমিটেড।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন