এবারও সরকার নির্ধারিত দাম পায়নি চামড়া বিক্রেতারা। দাম না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিক্রেতারা। এর আগেও কোরবানির চামড়ার দাম না পেয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ‘গরিবের হক’ হিসেবে পরিচিত কোরবানির চামড়ার দাম থেকে গরিবরা বঞ্চিত হচ্ছে। এবার চামড়ার দাম নিয়ে ট্যানারি মালিকদের কারসাজি এতটাই লক্ষ্য করা গেছে যে, লাখ টাকার গরুর চামড়া আড়াইশ’ টাকায়ও বিক্রি করা যায়নি। অথচ বছর দুয়েক আগেও মাঝারি সাইজের একটি গরুর চামড়া এর চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। এবার বড় ধরনের চামড়া আগের দামে বিক্রি করা যায়নি। এর প্রতিবাদে অনেকই চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। সরকার প্রতি বছরই কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়। অথচ সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয় না। এর জন্য চামড়া সিন্ডিকেটদের দায়ী করা হয়। তাদের কারসাজিতে চামড়ার প্রকৃত দাম পাওয়া যায় না। এই দাম না পাওয়ার কারণে একদিকে যেমন গরিবরা বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশ থেকে চামড়া পাচার হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
বছরের প্রায় ৭০ শতাংশ চামড়া কোরবানি থেকে সংগৃহীত হয়। এসব চামড়া দিয়েই ট্যানারি শিল্প টিকে আছে। কোরবানির চামড়ার উপর যেমন ট্যানারি শিল্প টিকে থাকে, তেমনি এ থেকে প্রাপ্ত অর্থে মাদরাসা ও এতিমখানার উল্লেখযোগ্য খরচের যোগান আসে। দরিদ্র মানুষও এ থেকে অর্থ পায়। চামড়ার দাম পেলে মাদরাসা ও এতিমখানার লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভরণ-পোষণের কাজটি সহজ হয়। এটি তাদের হক। কোরবানি দাতারাও চামড়া বা এর বিক্রিত অর্থ মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করে। দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিবছরই চামড়ার দাম কমছে। দরিদ্র ও অসহায়দের হক বলতে কিছু থাকছে না। এ বছর দাম এতটাই কম যে অনেক মাদরাসা ও এতিমখানাকে চামড়া নিতে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্যানারি মালিক ও সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানির চামড়ার মূল্য এখন সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এক্ষেত্রে তারা চামড়া সংরক্ষণের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাসহ নানা অজুহাত দেখালেও তার যথাযথ কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে সরকারের চরম ব্যর্থতা রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রুটিন মোতাবেক গরু-ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। বিক্রেতারা দাম পাচ্ছে কিনা, তা দেখার প্রয়োজন মনে করে না। মন্ত্রণালয়ের এই উদাসীনতা ও তদারকি না থাকায় নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয় না বা হচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার কোরবানির চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কমিটিগুলোর কাজ হচ্ছে, কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ক্রেতা-বিক্রেতা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা এবং অন্যান্য স্থানে সংরক্ষিত চামড়ায় যথাসময়ে প্রয়োজনীয় লবণ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। এই কমিটি কতটা দায়িত্ব পালন করেছে, সেটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। অথচ করোনার এই সময়ে সরকারের উচিৎ ছিল, চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে দেশের দুর্দশাগ্রস্থ লাখ লাখ মাদরাসা-এতিমখানার শিক্ষার্থী ও দরিদ্র মানুষের হক নিশ্চিত করা। এ কাজ করা কঠিন কিছু ছিল না। এর মাধ্যমে সরকারের প্রণোদনার কাজটি যেমন হতো, তেমনি শিক্ষার্থী ও দরিদ্ররা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত। পানির দরে চামড়া বিক্রির এ সুযোগে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি চামড়া পাচারের অশংকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যথাযথ মূল্য নির্ধারণে সরকারের ভুল নীতি। প্রতি বছর চামড়ার মূল্য বৃদ্ধি করলে এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ নিলে বিক্রেতারা সঠিক মূল্য পেত, গরিবের হকও রক্ষা হতো। দুঃখের বিষয়, সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ না থাকায় ট্যানারি মালিক ও সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছা মতো দামে চামড়া কিনে গরিবের হক মেরে দিচ্ছে। যারা কোরবানি দিয়েছে তারা চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে যেখানে অসহায় ও দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াত, সেখানে ট্যানারি মালিক ও সিন্ডিকেট তাদের এই মহৎ উদ্যোগ বানচাল করে দিচ্ছে। চামড়া কেনবেচার সাথে অনেক বেকার তরুণ-যুবকও জড়িয়ে থাকে। বছরের এই সময়টাতে তারা চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রির মাধ্যমে কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে লাভবান হয়। এদের অনেকে এ বছর চামড়া কিনে বিক্রি করতে গিয়ে লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আগামী বছরগুলোতেও যদি কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি চলতে থাকে, তাহলে এ খাতে চরম ধস নেমে আসবে। চামড়ার দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি চামড়া সংগ্রহেও ঘাটতি দেখা দেবে। আমরা মনে করি, সরকারকে কোরবানির চামড়ার দাম বৃদ্ধি এবং নির্ধারিত দামে তা বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন