শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মালয়েশিয়ায় দু’লক্ষাধিক প্রবাসী আতঙ্কে

ডেডলাইন ৩১ ডিসেম্বর লকডাউনেও ব্যাপক ধরপাকড় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কড়া হুঁশিয়ারি

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

বৈশ্বিক করোনা মহামারির কঠোর লকডাউনের মাঝেও মালয়েশিয়ার জনবসতি এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। দেশটির সরকার জননিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বৈধতা লাভের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি চালু করছে। দেশটির অবৈধ অভিবাসী কর্মীরা কোনো প্রকার দালাল ছাড়াই মালিকের মাধ্যমে ৫শ’ রিঙ্গিত জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে বৈধতা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে অবৈধ কর্মীরা বিমানের টিকিট ক্রয় করে বিমান বন্দরে গিয়ে ৫শ’ রিঙ্গিত জরিমানা দিয়েই আউটপাস নিয়ে কোনো প্রকার শাস্তি ছাড়াই স্ব-স্ব দেশে ফেরার সুযোগ পাচ্ছে। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে নতুন পাসপোর্টের জন্য কর্মীদের মাঝে চলছে হাহাকার। পাসপোর্টের অভাবে অনেকেই বৈধতা লাভের রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। প্রবাসী কর্মীরা একটি নতুন পাসপোর্ট হাতে পেতে ৭ থেকে ৮ মাস সময় লাগছে। আবার দালালদের মাধ্যমে গেলে অনেকেই দ্রুত পাসপোর্ট পাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে।

সম্প্রতি দেশটির ইমিগ্রেশনের প্রধান দাতো ইন্দিরা খায়রুল দাজাইমি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, অবৈধ কর্মীরা ধরা পড়লে দশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা এবং এক বছর থেকে ৫ বছরের জেল এবং ছয় এর অধিক বেত্রাঘাত দেয়া হবে। এতে দেশটিতে ঘরবন্দি দু’লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী চরম আতঙ্কে ভুগছেন। দেশটিতে ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে।

বিএমইটির সূত্র মতে, ১৯৭৮ সাল থেকে এ যাবত মালয়েশিয়ায় ১০ লাখ ৫৭ হাজার ১৯৫ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। কমাস আগে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান এক চিঠিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদকে জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার প্লানটেশন খাতে ৩২ হাজার কর্মী নেয়া হবে। তবে করোনা টিকা গ্রহণ ছাড়া কোনো বাংলাদেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খাতেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া হবে বলেও ঐ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলাচলের বা প্রবেশের বিধিনিষেধের ফলে নতুন করে জনশক্তি রফতানির বাজার থমকে গেছে। কর্মী রিসিভিং কান্ট্রিগুলো নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশি মনোযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি নিজ দেশে থাকা বিদেশি অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার কৌশল নিয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে মালয়েশিয়া সরকার দেশটিতে অবস্থান করা বিদেশি অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দেয়ার রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি চালু করে। দেশটির কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে নতুন পাসপোর্টের জন্য চলছে হাহাকার। শত শত অবৈধ কর্মীরা নতুন পাসপোর্টের অভাবে রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। হাইকমিশনে নতুন পাসপোর্ট আসার পরে তিন মাসেও ডেলিভারি পাচ্ছে না অনেক প্রবাসী কর্মী। কুয়ালালামপুর থেকে একাধিক ভুক্তভোগি এতথ্য জানিয়েছে।

এ সুযোগ নিয়ে বৈধভাবে অবস্থান করার জন্য সোর্সকান্ট্রি অন্তর্ভুক্ত ১৫টি দেশের নাগরিকদের অনুরোধ করেছে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস। এটি মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের এবং নিয়োগকর্তাদের শৃঙ্খলিত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা। কীভাবে বৈধ হতে হবে সে বিষয়ে ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সামনে এক বৈঠকে বৈধকরণ কর্মসূচির প্রক্রিয়া তুলে ধরেছেন দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।

করোনা মহামারিতে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছুটিতে দেশে আটকে পড়া মালয়েশিয়ার প্রবাসী হাজার হাজার কর্মী এখনো দেশটিতে যেতে পারেনি। অনেকেরই ভিসার মেয়াদ চলে যাচ্ছে।
রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচির আওতায় বৈধ হবার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত ও যোগ্যতা আরোপ করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। যেমন বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় এসে ভিসায় উল্লেখিত নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করছে কিন্তু ভিসা রিনিউ করেনি বা ওভার স্টে হয়েছে, নিজ নিজ কোম্পানিতে কাজ করেনি এবং কোম্পানি থেকে পালিয়ে গেছে। এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতে হবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ এর মধ্যে। এরপর হলে হবে না।

এর আগে দেশটির সরকার ২০১৬ সালে রিহায়ারিং প্রক্রিয়ায় ভেন্ডর বা এজেন্ট ছিল এবার কোনো ভেন্ডর বা এজেন্ট নিয়োগ করেনি সরকার। গত রিহায়ারিং এ বৈধ হবার জন্য আবেদন করে প্রতারিত হবার মূল কারণ ছিল সেই সব ভেন্ডর বা এজেন্ট। ফলে এবার কোনো এজেন্ট নিয়োগ করেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
এটি মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ওয়েব সাইট এবং ফেসবুক পেজে প্রচার করছে। এবার কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা সরাসরি ইমিগ্রেশনে কর্মীদের নামের তালিকা জমা দিয়ে বৈধতার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। কোম্পানি নিয়োগ করতে পারবে কি না তা যাচাই করবে লেবার ডিপার্টমেন্ট।

অর্থাৎ বিদেশি কর্মী নিয়োগের কোটা না থাকলে নিয়োগ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ নিয়ে সটকে পড়তে পারবে না। রিহায়ারিং এর সময় অনেক ভুয়া ও ভুঁইফোড় কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা বৈধতার নামে প্রতারণা করেছিল। যদিও হাইকমিশন থেকে সতর্ক করে লিফলেট, টিভিসি এবং অন্যান্য প্রচার করেছিল। কিন্তু দালাল ও প্রতারকদের চটকদার কথা এবং কর্মীদের নিজেদের তথ্য গোপন করার ফলে সহজেই প্রতারিত হয়েছে। এবার এদের বৈধ করার জন্য স্পেশ্যাল সুযোগ দেয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিসা করে দেয়া প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মীরা বেশি প্রতারিত হয়। এ জন্য দালালদের বা এজেন্টের নিকট অর্থ ও পাসপোর্ট দিয়ে থাকে।

জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সভাপতি মো. নাজমুল ইসলাম বাবুল গতকাল রোববার কুয়ালালামপুর থেকে ইনকিলাবকে জানান, বর্তমানে করোনার কারণে টানা লকডাউনে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন অবস্থায় অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতারা এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘরবন্দি প্রবাসীদের মাঝে যথা সম্ভব খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে ঘরবন্দি অসহায় লাখ লাখ প্রবাসী কর্মীদের সহায়তার হাত বাড়াতে দেখা যায়নি। শ্রমিক নেতা নাজমুল ইসলাম বাবুল বলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মীরা পাসপোর্ট জটিলতায় চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। হাইকমিশন থেকে একটা পাসপোর্ট পেতে কমপক্ষে ছয় থেকে আট মাস লেগে যাচ্ছে। যার ফলে অনেক শ্রমিক পারমিট নবায়ন করতে পারছে না। যার ফলে বৈধ কর্মীরাও অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন বা অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচির অধীনে অবৈধ থেকে বৈধ হওয়া এবং অবৈধ লোক দেশে যাওয়ার সুযোগ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান আছে। পাসপোর্ট ডেলিভারি বিলম্ব হওয়ার কারণে অনেকেই বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনের মাঝে অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতারে দেশটিতে চিরুনি অভিযান চলছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ এই দেশে পুলিশ বা ইমিগ্রেশনের হাতে ধরা পড়ে কারাবন্দি হচ্ছে। তিনি বলেন, হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট ডেলিভারি নিতে হয় পোস্ট ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট মাধ্যমে যে বলা আছে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পাসপোর্ট ডেলিভারি পাওয়া যাবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় দুই মাসেও পাসপোর্ট ডেলিভারি পাওয়া যায় না। এতে করে প্রবাসী কর্মীরা মারাত্মকভাবে হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাসপোর্টের সঙ্কট দ্রুত নিরসনের দাবিতে কুয়ালালামপুরস্থ হাইকমিশনে স্বারকলিপি প্রদান করেও কোনো সুরাহা পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব বিষয় দেখার কেউ নেই। তিনি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধরে রাখা এবং লাখ লাখ প্রবাসী কর্মীর স্বার্থে পাসপোর্ট সঙ্কট নিরসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

কুয়ালালামপুর থেকে গতকার আওয়ামী লীগ মালয়েশিয়া শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াহিদুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়া সরকার আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অবৈধ প্রবাসী কর্মীদের বৈধতা লাভের সুন্দর সুযোগ দিয়েছেন। কিন্ত অধিকাংশ অবৈধ বাংলাদেশি এ সুযোগ কাজে না লাগিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। দেশটির আইন মানে না এসব অবৈধ কর্মীরা। পুলিশি অভিযানে গ্রেফতার হয়ে অনেকেই কারাভোগ করছে। তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনের মাঝেও ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। লাখ লাখ অবৈধ কর্মীর মাঝে চরম গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে পাসপোর্ট আসতে দেরি এবং ডিএস এল এর মাধ্যমে পাসপোর্ট ডেলিভারি পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে বহু কর্মী পাসপোর্টের অভাবে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াহিদুর রহমান বলেন, শনিবার দেশটিতে করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৪ জন মারা গেছে আর আক্রান্ত হয়েছে ১৫ হাজার ৯৮৪ জন। গতকাল রোববার দেশটিতে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৫ জনে। ঘরবন্দি প্রবাসী কর্মীরা চরম দুর্দিন অতিক্রম করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোঃ+দুলাল+মিয়া ২৬ জুলাই, ২০২১, ৪:৩৬ এএম says : 0
যেখানে আম দেওয়ার দরকার সেখানে দেয় না,
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন