শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মেডিক্যাল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে

ফারিয়া জান্নাত | প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

উন্নত দেশগুলোতে Solid Waste Management বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়েছে। গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা সহ দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য, আবর্জনা এবং এদের ব্যবস্থাপনা ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মেডিক্যাল বা চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বহির্বিশ্বে স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রাখতে এই মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। আর এ ব্যাপারটিই দিনে দিনে খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ, মেডিক্যাল বর্জ্য মারাত্মক এবং বিপজ্জনক। প্রতিদিন প্রায় টনকে টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই বর্জ্যগুলোর বেশির ভাগই কোনো ধরনের নিয়মকানুন ছাড়াই নদী, নালা, খাল, বিলে ফেলে দেয়া হচ্ছে অথবা নিয়ম ছাড়াই পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা মাটিতে পুঁতে দেয়া হচ্ছে। এতে যেমন বর্জ্য নিষ্কাশন সঠিকভাবে হয়ে উঠছে না, ঠিক তেমনি পরিবেশের উপরও ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা বা নিষ্কাশন করতে পারা। সাধারণত মেডিকেল বর্জ্য বলতে আমরা বুঝি ব্যবহৃত সুঁচ, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, ব্যবহৃত মাস্ক, পিপিই (পারসোনাল প্রটেকশান ইকুইপমেন্ট), খালি বা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া ওষুধের বোতল, রক্তমাখা প্লাস্টিকের সামগ্রীসহ আরো বেশ কিছু উপাদান, যা ব্যবহারের পর বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর উপাদানে পরিণত হয়। বর্তমানে দেশের হাসপাতালগুলোতে বেশিরভাগ সময় ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। ফলে প্রতিদিন উল্লখযোগ্য হারে বাড়ছে মেডিক্যাল বর্জ্য। আর এগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার অভাবে সংক্রামক রোগব্যাধি বেড়ে যাচ্ছে।

দেশের শহরগুলোর হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা মোটেও সুবিধাজনক নয়। এমনকি মাঝে মাঝে দেখা যায়, মেডিকেল বর্জ্য যেমন রক্ত, পুঁজ মিশ্রিত তুলা, ব্যান্ডেজ, রক্তের ব্যাগ এসব ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়। গবেষণায় পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয় শুধুমাত্র এই মেডিকেল বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে বাংলাদেশের কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই বর্তমানে মেডিকেল বর্জ্যের সুষ্ঠু নিষ্কাশনের মানসম্মত কোনো ব্যবস্থাই নেই। ২০০৮ সালে মেডিক্যাল বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হলেও সে আইন দুর্বল হওয়ায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

বর্তমানে করোনাকালে মেডিক্যাল বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থায় অনিয়ম দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। কারণ, একদিকে মেডিক্যাল বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে এবং সেই সাথে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এই সময়টাতে জনসাধারণের মাস্ক, গ্লাভস, পিপিইসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার বেড়ে গেছে। কিন্তু এসব ব্যবহারের পর এসব বর্জ্য নিষ্কাশনের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় যেখানে সেখানে ফেলে দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল এবং ৫ হাজার ৫৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১.৬৩ থেকে ১.৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোভিডের সময়ে এই পরিমাণ আরো বেড়েছে। কারণ ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী শুধু রাজধানীতে কোভিডের কারণে ২০৬ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ৬.৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে। বাকি ৯৩.৪ ভাগের কোন সঠিক ব্যবস্থাপনা হয় না। রাজধানীসহ সারাদেশে মেডিকেল বর্জ্য এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (ইএসডিও)’র ২০২০ সালের জুন মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের মে মাসে শুধুমাত্র রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রায় ২৫০ টন মেডিকেল বর্জ্য সংগৃহীত হয়েছে। কিন্তু করোনাকালে এর পরিমাণ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। মেডিক্যাল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভ মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা এবং তারপর তা উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলার নিয়ম থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক সে নিয়ম মেনে চলে। বেশিরভাগ হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই এ নিয়মগুলো মোটেও মেনে চলা হয় না। তবে জনসাধারণের একটি বড় অংশই কোন ধরনের নিয়ম মেনে চলে না। তারা মাস্ক ব্যবহার করে এবং যেখানে সেখানে ফেলে দেয়। শুধু মাস্ক নয়, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার ব্যাবহারের পর খালি বোতল যত্রতত্র ফেলে দেয়া হয়। এগুলো পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।

গবেষণায় আরো প্রকাশিত হয়, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ যেসব সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে তার থেকে প্রতিদিন ২৮২.৪৫ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার পুরোটাই অপসারিত হয় গৃহস্থালি বর্জ্যের সাথে। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের থেকে শহরাঞ্চলে এসব সুরক্ষা সামগ্রীর হার বেশি। কিন্তু যারা এসব ব্যবহার করে, এসব সুরক্ষা সামগ্রী নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্ঞান না থাকায় তারা এসব অপসারণ করে ফেলে গৃহস্থালি বর্জ্যের সাথে। মেডিক্যাল বর্জ্যসহ আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত চা, কফি, মুদি দোকানের পলিথিন এসব ব্যবহার করা হয়, যা ৫০ বছর পর্যন্ত নষ্ট হয় না। পরিবেশে থেকে যায়। ফলে আমাদের পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর। আর এসব পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন প্রাণীকূলের উপর দেখা যায়। এসবের প্রভাবে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীরা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমনঃ শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ক্যানসার ইত্যাদি। মেডিকেল বর্জ্য আমাদের ভূমি ক্ষয়ের জন্য ও প্রত্যক্ষভাবে অনেকাংশে দায়ী। জমির উর্বরতা কমে যায় এসব বর্জ্য মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার দরুণ, যা থেকে পরবর্তীতে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।

আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার জন্য সঠিক নিয়মকানুন, নীতিমালা বাস্তবায়ন করার উপযুক্ত সময় এখনি। কারণ, এই মেডিকেল বর্জ্যের ভয়াবহতায় জনজীবন হুমকির সম্মুখীন। তাই হাসপাতালগুলোর মেডিকেল বর্জ্যসমূহ সঠিক নির্দেশনা মেনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সাধারণ মানুষ যারা মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, তারা এগুলো যেখানে সেখানে না ফেলে কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে বেশ কিছুদিনের ব্যবহৃত বর্জ্য একত্রিত করে পুড়িয়ে ফেলবে। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা দরকার। সরকারি পর্যায়ে এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে জনগণকে সচেতন করে তুলতে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কালার কোড অনুযায়ী ময়লা উৎপাদন স্থল আলাদা করতে হবে। বর্জ্য খোলা অবস্থায় পরিবহন নিষিদ্ধ করতে হবে। এগুলোর শ্রেণীভেদে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। আমরা অনেক সময়ই এমন অনেক সংবাদ পেয়ে থাকি যে কিছু অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী বা চক্র এসব ডিসপোজিবল বর্জ্য যেমন সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ, এসব ডাম্পিং স্টেশন থেকে তুলে নিয়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে বাজারে ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে যারা এসব ব্যবহার করে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এসব থেকে সচেতন থাকতে হবে। যদি হাসপাতালের বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করা যায় তবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে খুব দ্রæত। ফলে আমরা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবো।

এছাড়া ২০০৮ সালের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশন সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। প্রতিটি হাসপাতালের সাথে যুক্ত থাকবে মেডিকেল ইনসিনেরেটর এবং অটোক্লেভসহ আধুনিক সকল ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য বাজেটে সকল হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অবশ্যই মেনে চলতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান(আইইডিসিআর) এর পরামর্শক ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, ‘মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভসসহ যেকোন ধরনের মেডিকেল বর্জ্য বাইরে ফেলে রাখা উচিত নয়। সরকারি-বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানই হোক, তাদের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে গাইডলাইনস আছে সেগুলো অনুসরণ করে কাজ করা উচিত। করোনার এই সময় যেভাবে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে তাতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যত্রতত্র ফেলা এসব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষের মাঝে ছড়াবে। কাক মুখে নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ফেলবে, সেখান থেকে ছড়াবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে তা বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখা। পরে এসব বর্জ্য উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ফেলতে হবে।’ এসকল গাইডলাইন সঠিকভাবে মেনে চলা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা আনয়নের মাধ্যমে আমরা মেডিকেল বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারি এবং পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে পারি।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন