শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

ধর্মীয় বিষয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা এবং দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার-২

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২১, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের সংসদে একজন কমিউনিস্ট ভাবধারার এমপি একবার বলেছিলেন, মহানবী (সা.) নিজেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। এটি তাদের ধারণার ধর্মনিরপেক্ষতা। তারা গভীরভাবে চিন্তা করতে চান না যে, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে সেক্যুলারিজমের ভাবানুবাদ। যার মূল অর্থ ধর্মহীনতা। আগেই বলা হয়েছে, একটি ধর্মের নবী কেন এবং কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হবেন। তিনি সকল ধর্মের মানুষের সামাজিক ও মানবিক অধিকার দেওয়ার পক্ষে একটি সহনশীল রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা দান করে গিয়েছেন।

সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত একজন দায়িত্বশীল (বর্তমানে মৃত) একবার দাবি করলেন, মদীনা সনদ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং এর শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ছিল না। বিষয়টি নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল বেশ হই চই ফেলে দিলে এই ভুল তথ্য রদ করা কিছু উলামা মাশায়েখ ও দীনদার বুদ্ধিজীবী নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করেন। বিখ্যাত সব ইতিহাসগ্রন্থ থেকে মদীনা সনদের অধ্যায় ফটো করে ওই মহলটির কাছে পেশ করা হয়। স্পষ্ট হরফে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়।

আর মদীনা সনদের শুরুতে আল্লাহর কালেমা, তাওহীদ ও রেসালতের সাক্ষ্য এবং মদীনার সব ধর্মের নাগরিকরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্ব মেনে একটি নাগরিক শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলার যে চুক্তিপত্রে সম্মতি প্রদান করে, এরই নাম ছিল মদীনা সনদ বলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এটি ইসলামের কোনো চিরস্থায়ী রাষ্ট্রদর্শন বা বিধান নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টান্তও নয়। এটিকে অজ্ঞতা, হঠকারিতা বা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ কোনো সনদ বলা মোটেও ইসলামসম্মত নয়।

সাহাবায়ে কেরাম হজরত নবী করিম (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলতেন, রায়িনা ইয়া রাসুল সা.। অর্থাৎ হে রাসুল, আপনি আমাদেরকে তদারকি করুন। এ শব্দটির আরেকটি অর্থ হচ্ছে, হে আমাদের রাখাল। মক্কার মুশরিকরা এই দ্বিতীয় অর্থে কথাটি ব্যবহার করে সাহাবীদের কথার বিদ্রুপ করতো। তখন আল্লাহ সাহাবীদের বললেন, তোমরা রায়িনা বলো না, বলো উনজুরনা। এর অর্থ হে রাসুল, আপনি আমাদের প্রতি তত্ত্বাবধায়কের দৃষ্টিতে তাকান। আমাদেরকে সফল মানুষ হিসাবে গড়ে তুলুন। আমাদের প্রতি নেকদৃষ্টি দিন।

দ্ব্যর্থহীন শব্দ ব্যবহার করা ইসলামের শিক্ষা। একটি শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে। শত্রুরা এর অপব্যবহার করতে পারে। অতএব দ্ব্যর্থবোধক শব্দ বাদ দিয়ে স্পষ্ট এবং একার্থবোধক শব্দ ব্যবহার করার নির্দেশ আল্লাহ মুসলমানদের দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন : হে মুমিনগণ! তোমরা ‘রা‘ইনা’ বলে সম্বোধন করো না, (যার অর্থ আমাদের রাখাল) বরং তোমরা বলবে ‘উনজুরনা’ (অর্থাৎ আমাদের প্রতি নেকদৃষ্টি দিবেন।) এবং শুনে নাও, বস্তুতঃ অবিশ্বাসীদের জন্যই রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। (সূরা বাকারাহ : ১০৪)।

বিদেশী শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমরা যেন কুফরী, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদী অপসংস্কৃতির শিকার না হই। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন ধর্ম কিংবা ইসলামসম্মত নয় এমন কোনো বিশ্বব্যবস্থা জীবনবিধান তন্ত্র ইজম বা মতবাদ অনুসরণ করা যাবে না। আল্লাহ, রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং দীনকে মানার পথ সুস্পষ্ট। মুসলমানদের এর বাইরে যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। যাদের বিষয়টি জানা নেই বা জানলেও অস্পষ্ট, তারা ভালো করে জেনে নিন।

সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর কেন, বলুন আল্লাহ। চেতনা কেন, বলুন ঈমান আকিদা। রাজনীতি কেন, বলুন রাষ্ট্র, সরকার ও বিচারব্যবস্থায় দীনের কালেমাকে বিজয়ী করার সুন্নাহসম্মত কর্মপন্থা। বিপ্লব, আন্দোলন, সংগ্রাম কেন, বলুন, শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থনীতিসহ গোটা সমাজব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের লক্ষ্যে দাওয়াত তালীম তারবিয়া ও ইসলাহি কাজ।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা কেন, বলুন ‘কোরআন সুন্নাহ ও শরীয়াহ’। ডেমোক্রেসি কেন, বলুন ‘জনগণের ক্ষমতা, অধিকার ও স্বাধীনতা’। সেক্যুলারিজম কেন, বলুন ‘নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার’। সোশ্যালিজম কেন, বলুন ‘অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সুবিচার’। জাতীয়তাবাদ কেন, বলুন ‘দেশের মানুষের নাগরিক ও আর্থসামাজিক অগ্রাধিকার’। আইনের শাসন কেন, বলুন ‘ইসলামের সুশাসন ও ন্যায়বিচার’। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ কেন, বলুন ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’। সুফিবাদ কেন, বলুন ‘তাসাওওফ, তরিকা, তাযকিয়া ও ইহসান’।

আমাদের সংবিধানের সোশ্যালিজম শব্দটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইজম বোঝায়। যদিও সংবিধান রচয়িতাদের অনেকেরই শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের ঈমানের দাবি সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং বিশ্ব মোড়লদের তাবেদারিজনিত কারণে এসব সাম্রাজ্যবাদী পরিভাষা স্বাধীন দেশের সংবিধানে প্রবিষ্ট হয়। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্র ও সমাজদর্শন থাকা সত্তে¡ও ঈমানবিরোধী পশ্চিমা দর্শন বঙ্গবন্ধু আলাদা ব্যাখা দিয়ে শোষণহীন সমাজ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি বোঝাতেই সংবিধানের অংশ করেছেন। গণপরিষদ বঙ্গবন্ধুর নেওয়া অর্থেই এসব বিষয় সংবিধানের অংশ করেছে। প্রণেতাদের অর্থে আসল মার্ক্সিজম বোঝাতে অবশ্যই নয়। কারণ বঙ্গবন্ধু বা তার দল কোনোদিনই মার্ক্সবাদী ছিলেন না। অর্থনীতি বিষয়ক কিছু বিষয় বোঝানো ছাড়া নাস্তিক্যবাদী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত পরিপূর্ণ মার্ক্সবাদ ১০০ ভাগ সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধানে রাখার যৌক্তিকতাও যে নেই।

কেননা কার্ল মার্ক্স নিজেই তার পুস্তকে বলে দিয়েছেন, আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করা মার্ক্সবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এদেইজম ইজ দ্য আনসেপারেবল পার্ট অব মার্ক্সিজম। (দ্য ক্যাপিটাল।)

মুসলিম বিশ্বের আইন রচয়িতাদের উচিৎ ধর্মহীন সেক্যুলারিজম না বলে সব ধর্মের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার ও স্বাধীনতা বলা। তাদের কর্তব্য নাস্তিক্যবাদী সোশ্যালিজম না বলে অর্থনৈতিক মুক্তি ও শোষণহীন সমাজ বলা। অর্থ বিভ্রাট বা অপব্যাখ্যা হতে পারে এমন ক্ষতিকর পরিভাষা না ব্যবহার করাই উচিৎ। আল্লাহর কোরআন থেকেই আমরা এ শিক্ষা পেতে পারি যে, ঈমান, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীন শব্দের ব্যবহার অধিক বাস্তবসম্মত ও নিরাপদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
জহির ২৯ জুলাই, ২০২১, ৩:০৫ এএম says : 0
ধর্মীয় বিষয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার কোন সুযোগ নেই
Total Reply(0)
Mahbub Rahman ২৯ জুলাই, ২০২১, ৩:০৮ এএম says : 0
ধারাবাহিক ও তথ্যভিত্তিক এই সুন্দর লেখাটির জন্য লেখক উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেবকে অসংখ্যা মোবারকবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
শফিকুল ইসলাম ২৯ জুলাই, ২০২১, ৩:০৯ এএম says : 0
এই ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী লেখার জন্যই দৈনিক ইনকিলাব নিয়মিত পড়ে থাকি
Total Reply(0)
লোকমান ২৯ জুলাই, ২০২১, ৩:০৯ এএম says : 0
আল্লাহ আমাদেরকে এসব বোঝে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তৌফিক দান করুক।
Total Reply(0)
Monzoor ২৯ জুলাই, ২০২১, ৮:১৬ এএম says : 0
What is তরিকা, please explain base on Quran & Sunnah
Total Reply(0)
jackali ২৯ জুলাই, ২০২১, ৬:৩৬ পিএম says : 0
আলী রাদিয়াল্লাহু বলতেন যে যুগে যুগে ইসলামকে ধ্বংস করবে দরবারী আলেম ও শাসকগণ. “তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফেল নন”। সূরা বাকারা: (৮৫) ইসলামে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত কোনো বিষয় যে প্রত্যাখ্যান করল, সে কাফের ও পথভ্রষ্ট, যদিও তার প্রত্যাখ্যান করা বিষয়ের পরিমাণ খুব কম ও সামান্য হয়। অতএব পার্থিব রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ইসলামের সকল বিধান যে প্রত্যাখ্যান করে, সে কাফের বলার অপেক্ষা রাখে না, যেমন সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা।
Total Reply(0)
jackali ২৯ জুলাই, ২০২১, ৬:৩৭ পিএম says : 0
ইসলামে নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত কোনো বিষয় যে প্রত্যাখ্যান করল, সে কাফের ও পথভ্রষ্ট, যদিও তার প্রত্যাখ্যান করা বিষয়ের পরিমাণ খুব কম ও সামান্য হয়। অতএব পার্থিব রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ইসলামের সকল বিধান যে প্রত্যাখ্যান করে, সে কাফের বলার অপেক্ষা রাখে না, যেমন সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা।
Total Reply(0)
jackali ২৯ জুলাই, ২০২১, ৬:৩৭ পিএম says : 0
Surah:40: Ayat:56: “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে তাদের কাছে আগত কোন দলিল ব্যতিরেকে তাদের অন্তরে আছে কেবল অহংকার, যা অর্জনে তারা সফল হবে না, অতএব আপনি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন নিশ্চয় তিনি সবকিছু শোনেন সবকিছু দেখেন.” ইবনুল কাইয়ুম রহমতউল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন. “ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন কেউ কি ছিলেন যারা রাসূলের বক্তব্য শোনার পর একে নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, রুচি, অনুভূতি কিংবা নীতির মাধ্যমে বিরোধিতা করেছেন???? তাদের কেউ কি কখনো রসুলের বক্তব্যের উপর নিজের যুক্তি বুদ্ধি কিংবা নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন????? আল্লাহ তা'আলা তাদের এসব থেকে রক্ষা করেছেন. হযরত ওমর [রাঃ] স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন যারা আল্লাহর রাসূলের কথার উপর ওমরের হুকুমকে প্রাধান্য দেবে তাদের গর্দান কাটা যাবে. সারা বিশ্বের মুসলিম শাসকদের তাহলে সবার গর্দান কাটা যাবে কিসের জন্য তারা তো আল্লাহর আইন দিয়ে দেশ চালায় না.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন