শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ক্ষমতার রাজনীতিতে ফিরতে চান গাদ্দাফি পুত্র

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০২১, ৪:৪২ পিএম

প্রথমে সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং তারপর আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিমান হামলার মুখে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে ২০১১ সালে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তবে গাদ্দাফির যে ছেলেকে বাবার উত্তরসূরী হিসাবে দেখা হতো, সেই সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

পশ্চিমা বিমান হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় ক'জন সঙ্গী নিয়ে পাশের দেশ নিজারে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে মরুশহর আওবারি থেকে একদল সশস্ত্র বিদ্রোহীর হাতে ধরা পড়েন সাইফ। তখন থেকেই তিনি 'জিনতান ব্রিগেড' নামের ওই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর কব্জায়। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ত্রিপোলির আদালতে তার মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে। কিন্তু জিনতান ব্রিগেড কারো কাছেই তাকে হস্তান্তর করেনি।

২০১৪ সালের পর গত সাত বছর সাইফ গাদ্দাফির কোনও খোঁজ কেউ পায়নি। তিনি বেঁচে আছেন কি নেই, তা লিবিয়ানদের কাছে তো বটেই বাকি বিশ্বের অনেকের কাছেও অনিশ্চিত ছিল। কিন্তু ৩০জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের সাপ্তাহিক সাময়িকীতে ছবিসহ সাইফ আল ইসলামের বিশাল একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর থেকে তা নিয়ে লিবিয়া এবং আরব বিশ্বে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সাংবাদিক এবং লেখক রবার্ট এফ ওয়ার্থকে সাইফ ইসলাম বলেন, গত ১০ বছরে লিবিয়া ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং দেশকে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে বাঁচাতে তিনি তার বাবার তৈরি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছেন। তার কথা ছিল, “আমি আমার দেশ ফেরত চাই।’

‘তারা আমার দেশকে ধর্ষণ করেছে। হাঁটুর ওপর বসিয়েছে। কোনও টাকা পয়সা নেই। জীবনের কোনও স্পন্দন নেই। আপনি গ্যাস স্টেশনে যান, সেখানে ডিজেল নেই। অথচ আমরা ইতালিতে তেল-গ্যাস রপ্তানি করি। ইতালির অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় আমাদের তেল-গ্যাসে। কিন্তু আমার দেশে লোডশেডিং,’ সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফিকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীতে।

মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং হত্যার ১০ বছর পর তার ছেলের কথার সাথে লিবিয়ার বহু মানুষ একমত হবেন। যে দুর্নীতির স্লোগান দিয়ে ২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, সেই দুর্নীতির বিষয়টি এখনও লিবিয়ার জনগণের প্রধান অভিযোগ। দারিদ্র এবং নিরাপত্তাহীনতা বহুগুণে বেড়েছে। সেই সাথে ক্রমাগত চলছে গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের নিরলস চেষ্টায় কলহরত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে সম্প্রতি ত্রিপোলিতে একটি জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করা হয়েছে। কিন্তু লিবিয়া এখনও কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। বেনগাজী শহর-সহ দেশের পূর্বাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন যুদ্ধবাজ সাবেক জেনারেল খালিফা হাফতার। পশ্চিমাংশ নিয়ন্ত্রণ করে একাধিক মিলিশিয়া গোষ্ঠী। ত্রিপোলিতে জাতিসংঘ অনুমোদিত সরকার অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়।

সাংবাদিক মি. ওয়ার্থ লিখেছেন, গত আড়াই বছর ধরে নানা সূত্রে খোঁজখবর এবং যোগাযোগ করে সাইফ আল ইসলামের খোঁজ পান তিনি। ত্রিপোলি থেকে গোপনে কয়েকবার গাড়ি বদল করে এই সাংবাদিক এবং তার ফটোগ্রাফারকে রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জিনতানের মরুভূমির ভেতর প্রত্যন্ত এক পাহাড়ী গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক বাড়ির কার্পেট মোড়া, ঝাড়বাতি ঝোলানো এক ঘরে মুখোমুখি বসে তাদের কথা হয়।

২০১১ সালের আগে সাইফ গাদ্দাফি ছিলেন লন্ডন অব ইকোনমিকসে পড়াশোনা করা চকচকে স্মার্ট এক যুবক। চোখে থাকতো রিম ছাড়া ডিজাইনার চশমা, কেতাদুরস্ত পশ্চিমা পোশাক। পশ্চিমা মিডিয়ার সাথে সাক্ষাৎকারে দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কার আর মানবাধিকারের কথা বলতেন। কিন্তু সাংবাদিক রবার্ট ওয়ার্থের সামনে বসা সেই সাইফের মুখে ছিল লম্বা দাড়ি। মাথায় পাগড়ী। পরনে উপসাগরীয় আরব শেখদের মত লম্বা জোব্বা। ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনী নেই - ২০১১ সালে নেটো বোমা হামলায় জখমের পরিণতি।

আপনি কি এখনও বন্দী? - সাংবাদিকের এই প্রশ্নে সাইফ আল ইসলামের জবাব ছিল, “আমি মুক্ত, এবং রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি।” তিনি বলেন, যে বিদ্রোহীরা তাকে বন্দী করে রেখেছিল, এখন তারাই তার প্রধান মিত্র । “ভেবে দেখুন, যারা এক সময় আমাকে পাহারা দিত, তারাই আমার বন্ধু “ ক্ষমতার রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার কথা বললেও সাইফ গাদ্দাফি পরিষ্কার করে বলেননি ডিসেম্বরে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা, তাতে তিনি দাঁড়াবেন কিনা।

কীভাবে এবং কবে লিবিয়ায় রাজনীতিকে তিনি ঢুকবেন, তার বাবার ‘গ্রিন মুভমেন্ট’কে নতুন করে দাঁড় করতে তার পরিকল্পনা কি, কিংবা তার সাথে কারা কারা আছেন – এ বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে চাননি সাইফ গাদ্দাফি। তিনি বলেন, “আমি বহুদিন লোকচক্ষুর বাইরে, আমাকে ধীরে ধীরে মানুষের সামনে আসতে হবে।”

সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফির এই সাক্ষাৎকার এবং ক্ষমতায় ফেরার বিষয়ে তার আকাঙ্ক্ষা কতটা আগ্রহ তৈরি করেছে লিবিয়ায়? লিবিয়ার মধ্যাঞ্চলীয় শহর সির্তের বাসিন্দা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী এবং ব্লগার মোজাম্মেল হোসেন তোহা বলেন, তোলপাড় না হলেও লিবিয়া এবং আরব বিশ্বের অনেক মিডিয়ায় এই সাক্ষাৎকারের খবর বেরিয়েছে এবং তা নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় গত দু'দিন ধরে অনেক মন্তব্য তর্ক-বিতর্ক চলছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান তিনি।

“মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখছি। ২০১৪ সালের পর সাইফ গাদ্দাফির কোন ছবি বা ভিডিও বের হয়নি। ফলে অনেকে বিভ্রান্ত। সাক্ষাৎকারের সাথে ছাপা লম্বা দাড়িওয়ালা ছবি দেখে অনেকে বলছেন এটা আসল সাইফ ইসলাম না, তার ছোট ভাই। নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হওয়ার কারণে অনেকে বলছেন এটা আমেরিকার আরেক কারসাজি। অনেকে আবার উৎফুল্ল।”

সাংবাদিক রবার্ট ওয়ার্থ বলছেন, সাইফ গাদ্দাফি এখন বিশ্বাস করেন যে ২০১১ সালের বিপ্লব নিয়ে লিবিয়ার মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে, তারা এখন হতাশ, অনুশোচনা করছে এবং তার বাবার শাসনামল নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগতে শুরু করেছে। তার কিছু নমুনা তিনি নিজেও দেখেছেন বলে ওই সাংবাদিক লিখেছেন। দু'টো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার তিনি উল্লেখ করেন - ত্রিপোলির কাছে একটি মহাসড়কের পাশে এক দোকানে ঢুকে তিনি দেখেন মানুষজন টিভিতে গাদ্দাফির ৮০-র দশকের একটি ভাষণ শুনছে। কায়রো ভিত্তিক একটি টিভি সেটি প্রচার করছিল।

আরেক ঘটনায় মে মাসে ত্রিপোলিতে এক রেস্তোরায় চারজন তরুণকে ওয়ার্থ প্রশ্ন করেন ডিসেম্বরের নির্বাচনে তারা কাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চান। তিনজনেরই উত্তর ছিল সাইফ আর ইসলাম। মোজাম্মেল তোহা বলেন, ১০ বছর আগের বিপ্লব নিয়ে অনেক মানুষের যে মোহভঙ্গ হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। “আমরাই এক সহকর্মী, যিনি ২০১১ সালে অস্ত্র হাতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি দু'দিন আগে আমাকে বললেন তিনি সাইফ আল ইসলামকে সমর্থন করবেন।”

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাদি হামদি বিবিসি বাংলাকে বলেন, নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাইফ গাদ্দাফির বক্তব্যে তিনি বিস্মিত হননি। তিনি জানান, গত কয়েক বছর ধরে কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে লিবিয়াতে সাইফ গাদ্দাফিকে নিয়ে কথা হচ্ছে।

“জিনতানে যে মিলিশিয়া গ্রুপটি তাকে ধরে রেখেছিল তারা কখনই ত্রিপোলি সরকারের শত চাপেও তাকে হস্তান্তর করেনি। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের চাপও কাজ করেনি। তারা হয়ত বুঝেছে কোনও না কোনও সময়ে সাইফের রাজনৈতিক মূল্য তৈরি হবে এবং তারা সেটাকে তাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারবে।” হামদি বলেন, ‘আরব বসন্ত’ যেসব দেশে সফল হয়েছিল সেগুলো একে একে আবার একনায়কদের হাতে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হচ্ছে। সাইফ আল ইসলাম এগুলো দেখছেন এবং তিনি হয়তো সত্যিই মনে করছেন লিবিয়ার জনগণ তার বাবার আমলে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব “

লিবিয়ায় বেশ কয়েকটি বিদেশী শক্তি - বিশেষ করে রাশিয়া, তুরস্ক, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত - সক্রিয় এবং তারা কী চায়, তার ওপর স্থানীয় শক্তিগুলোর ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করে।সাইফ গাদ্দাফির উত্থান এই বিদেশী শক্তিগুলোর মধ্যে কে কীভাবে নিতে পারে? সামি হামদি বলেন, রাশিয়ার সাথে বেশ কিছুদিন ধরে সাইফ গাদ্দাফির যোগাযোগ চলছে বলে ইঙ্গিত রয়েছে।

জেনারেল হাফতারের বড় সমর্থক রাশিয়া। মূলত রুশ সমর্থনের ওপর ভর করেই তিনি এতদিন দেশের পূর্বাঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছেন। তাছাড়া, গাদ্দাফি সমর্থকদের একটি বড় অংশ এখন হাফতারের ক্যাম্পে। ফলে, রাশিয়া খালিফা হাফতার এবং সাইফ গাদ্দাফির মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির বোঝাপড়ায় মধ্যস্থতা করতে পারে, ভবিষ্যতে এমন একটি সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছেন না মি. হামদি।

কিন্তু ত্রিপোলি সরকারের প্রধান সমর্থক তুরস্ক বা ইউএই এবং মিশর কি তা মেনে নেবে? সামি হামদি বলেন, “তুরস্কের সাথে গাদ্দাফি সরকারের ভালো সম্পর্ক ছিল। স্বার্থসিদ্ধি হলে তুরস্ক মিত্র বদলাতে পারে, সে নজীর রয়েছে। ইউএই এবং মিশর চায় লিবিয়ায় যেন রাজনৈতিক ইসলাম ঘাঁটি গাড়তে না পারে। সাইফ ইসলাম অবশ্যই মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থক নন।”

তাছাড়া, সাইফ ইসলামের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো লিবিয়ায় নানা শক্তির যে মেরুকরণ, এর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই বা দায় নেই। সুতরাং সব পক্ষের সাথে কথা বলা তার পক্ষে অনেক সহজ হবে। “গণতন্ত্রের চাইতে লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা এখন সবারই কাম্য। লিবিয়ার সাধারণ জনগণ, (মার্কিন প্রেসিডেন্ট) বাইডেন, ইউরোপ, (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) পুতিন সবাই এ নিয়ে উদগ্রীব।” স্থিতিশীলতার সেই ভরসা গাদ্দাফি-পুত্র দিতে পারবেন কি-না, তা এখনও কেউ জানে না। তার মাঠে না নামার আগে এটা বোঝা এখনও শক্ত। সূত্র : বিবিসি বাংলা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন