বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

রফতানি আয়ে হোঁচট

২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই মাস

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের বিস্তারে গত জুলাই মাসে মহামারীর সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ২৪ দিনই ছিল লকডাউন। এই অবস্থায় নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাসে পণ্য রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে শুরু হয়নি। জুলাই মাসে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৩৪৭ কোটি ৩৪ লাখ (৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি কমেছে ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা কমেছে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। লকডাউনে কারখানা বন্ধের প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাতও প্রবৃদ্ধি থেকে পিছিয়ে পড়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল রফতানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, নতুন ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম জুলাই মাসে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৩৪৭ কোটি ৩৪ লাখ (৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের বছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ৩৯১ কোটি ৯ লাখ ডলার। এ হিসাবেই প্রবৃদ্ধি কমেছে ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। রফতানিকারকরা বলছেন, করোনা মহামারিতে লকডাউন ও ঈদ-উল-আযহার কারণে টানা ১২ দিন বন্ধ ছিল রফতানিমুখী শিল্প কারখান। সে কারণেই রফতানি আয় কমে গেছে।

রফতানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম মাসে ২৮৮ কোটি ৭২ লাখ (২.৮৮ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। যা মোট রফতানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ। তবে টানা ১২ দিন কারখানা বন্ধ থাকায় গত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে পোশাক রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। একই সময়ে নিট পোশাক রফতানি হয়েছে ১৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা কমেছে শ‚ন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে ১২২ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এ খাতে ১৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমেছে। ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা কমেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, জুলাইয়ে ১৮ তারিখ পর্যন্ত আমাদের রফতানি আয় খুবই ভালো ছিল। তারপরে কোরবানি ঈদ ও কঠোর বিধিনিষেধে গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে হয়েছে। রফতানি কমার একমাত্র কারণ গার্মেন্টস বন্ধ থাকা। অন্য সময় তো নানা কারণে রফতানি কমে, এবার কমেছে শুধুমাত্র গার্মেন্টস বন্ধ থাকার কারণে। বরং আমাদের হাতে এখন প্রচুর অর্ডার আছে। আমরা অনেক অর্ডার পেয়েছি, কিন্তু কাজ করতে পারিনি। ২০২০ সালের জুলাইয়েও করোনার প্রভাব ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ছিলনা। এবার গার্মেন্টস বন্ধ না থাকলে আমরা ২০১৯ সালের জুলাইয়ের চেয়ে বেশি রফতানি করতে পারতাম।

একই ধরণের মন্তব্য করেছেন নীটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মো. হাতেম। তিনি বলেন, এবার জুলাই মাসে ১২ দিন কারখানা বন্ধ ছিল। ১৯ দিনে ২৮৮ কোটি ডলারের যে আয় হয়েছে তা খুবই ভালো। বন্ধ থাকার কারণে আমরা তো উৎপাদন করতে পারিনি। আর ২০২০ সালের জুলাইয়ে আমরা পুরো মাস করতে পেরেছিলাম। কারখানা চালু থাকলে জুলাই মাসে এবার সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি করা সম্ভব ছিল। অর্থাৎ রফতানি কম হওয়ার একমাত্র কারণ কারখানা বন্ধ থাকা। অন্য কোন কারণ নেই। বরং আমাদের হাতে এখন প্রচুর অর্ডার রয়েছে। বাংলাদেশকে টেক্কা দিয়ে পোশাক রফতানি আয়ে বিশ্বে ভিয়েতনামের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে মো. হাতেম বলেন, ভিয়েতনাম তিন কারণে আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। তাদের ওখানে কোন লকডাউন ছিলনা। ভৌগলিক কারণে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন এগিয়ে আছে। তারা সরাসরি পণ্য রফতানি করতে পারছে। আবার চীন থেকে সড়ক পথে তারা উপকরণ আমদানি করতে পারছে। তারা ২ থেকে ৩ দিনে উপকরণ আমদানি করতে পারছে। এক্ষেত্রেও তারা আমাদের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন এগিয়ে আছে। মূলত এই তিনটি কারণেই তারা এগিয়ে গেছে। তবে আমাদের বিশ্বাস পূর্ণদমে কারখানা চালু রাখতে পারলে এ বছরই আমরা আবার তাদের টেক্কা দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে পারবো।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, জুলাই মাসে কোরবানি ঈদ ছিল। কঠোর বিধিনিষিধে গার্মেন্টসও বন্ধ ছিল। ১৩ দিন কোন কাজ হয়নি। অর্থাৎ অর্ধেক মাসই আমরা কাজ করতে পারিনি। এখনও অনেক শ্রমিক কাজে ফিরেনি। মূলত কাজ বন্ধ থাকার কারণেই রফতানি আয় কম হয়েছে। তারপরও যে ২৮৮ কোটি ডলার রফতানি হয়েছে, এটি অনেক বেশি। বাংলাদেশকে টেক্কা দিয়ে পোশাক রফতানি আয়ে বিশ্বে ভিয়েতনামের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে এই পোশাক মালিক বলেন, ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে ছাড়িয়েই যেতে পারে। কারণ ওদের বিনিয়োগকারী চীন ও জাপান। আমাদের দেশের মতো ওদের নিয়ে বিশ্বে কোথাও এমন নেতিবাচক কথাবার্তা নেই। তাদের দেশে তাদের কর্মকাÐ নিয়ে নেতিবাচক কোন আলোচনা নেই। ফ্যাক্টরি খুলে দেওয়া হয়েছে এজন্য সরকার ও আমাদের সমালোচনার শেষ নেই। আর ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীরা আমাদরে তুলনায় নানা সুবিধায় রয়েছে। এসব কারণেই তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে।

এদিকে, পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম। কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থান করছিল দেশটির রফতানি আয়। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানেই উঠে গেছে ভিয়েতনাম। আর বাংলাদেশ এখন পোশাক রফতানিতে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। আর চীনের অবস্থান সবার উপরে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিøউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০২১ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। আর বাংলাদেশ রফতানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রফতানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার।

করোনা মহামারির মধ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি আয়ের উৎস চামড়া খাতে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করায় চাহিদা বেড়ে রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের এই খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে চামড়া রফতানি থেকে আয় এসেছে ৯ কোটি ৫ লাখ ডলার। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে শ‚ন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ।

করোনাভাইরাসের কারণে ধস নেমেছে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি আয়ে। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ ৩ কোটি ডলার আয় করেছে। রফতানির এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ কম। এ খাতের লক্ষ্য ছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

বিভিন্ন কৃষি পণ্য রফতানি করে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ৯ কোটি ৮১ লাখ ডলার আয় করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম অর্জিত হয়েছে। তবে আগের বছরের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে গত বছরের শেষ দিকে দেশের সব সরকারি পাটকল বন্ধের উদ্যোগ নেয় সরকার। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে ধস নেমেছে পাট রফতানিতে। জুলাই মাসে পাট রফতানিতে আয় এসেছে ৬ কোটি ৭ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪১ দশমিক ২৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন