মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যের পেছনে হাঁটতে হলে ইবাদত করতে হবে সযত্নে। ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত নামাজ। নামাজের অন্যতম একটি প্রকার নফল নামাজ। এটি পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ছাড়া অতিরিক্ত নামাজ। এর মধ্যে কিছু আছে এগুলোকে সুন্নত বলা হয়। আবার কিছু আছে এগুলোকে নফল বলে আখ্যায়িত করা হয়। এর জন্য আজান-ইকামতের দরকার পড়ে না।
নফল নামাজের প্রকার : নফল নামাজ দুই প্রকার। ১. এমন নফল নামাজ যার নির্ধারিত কোনো সময় নেই; বরং মাকরূহ ওয়াক্ত ব্যতীত যেকোনো সময় আদায় করা যায়। যেমন সালাতুল হাজত (প্রয়োজন পূরণের নামাজ), সালাতুল ইস্তিখারাহ, সালাতুত তাসবিহ, সালাতুত শোকর, তাহিয়্যাতুল অজু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ ইত্যাদি। ২. এমন নফল নামাজ যার নির্ধারিত সময় রয়েছে। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরবর্তী নফল, এ ছাড়াও সালাতুত দোহা, কিয়ামুল লাইল, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের নামাজ ইত্যাদি।
ফরজ নামাজের পর নফল নামাজের রয়েছে অনেক গুরুত্ব। নবীজি (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম নফল নামাজের খুব গুরুত্ব প্রদান করতেন। নবীজি সুস্থতা-অসুস্থতা, সফর-নিবাস, নিরাত্তা-যুদ্ধ সব সময় ফরজের পাশাপাশি যত্নবান ছিলেন নফল নামাজে।
নফল নামাজের উপকারিতা : নফল নামাজে বহুবিধ উপকার নিহিত। নফল নামাজ মহান আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। এর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। ফরজে হয়ে যাওয়া ত্রুটির ক্ষতিপূরণ হয়। নিজের আমলনামায় অতিরিক্ত কিছু নেকি অর্জন হয়। গুনাহ মিটে যায়। সওয়াব-প্রতিদান দিগুণ হয়। পূর্বের গুনাহ মাফ হয়। দুনিয়া-আখেরাতে উঁচু মর্যাদা লাভ হয়। মন-দিল পবিত্র হয়। অন্তর পরিশুদ্ধ হয়। এর ফাঁকে ফরজ নামাজটা খুব ভালোমত সম্পন্ন হয়ে যায়।
নফল নামাজের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে মহান আল্লাহর সমিপে সেজদা ছাড়া কেউ আল্লাহর ওলি, প্রিয় বান্দা হতে পারবে না। হজরত মাঅদান ইবনে আবু তালহা ইয়া‘মুরি বলেন, আমি রাসুলের (সা.) কৃতদাস সাওবানের (রা.) সঙ্গে দেখা করলাম। আমি তাকে বললাম, আমাকে এমন একটি আমল সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেন, যার দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকার করবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তিনি চুপ থাকলেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তিনি চুপ থাকলেন। অতঃপর আমি তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমি রাসুলকে (সা.) এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বলেছেন, আল্লাহকে অধিক পরিমাণে সেজদা কর। তুমি আল্লাহকে একটা সেজদা করলে এর দ্বারা আল্লাহ তোমার একটি স্তর উঁচু করে দেবেন এবং একটি গুনাহ মাফ করে দেবেন। মাঅদান বলেন, অতঃপর আমি আবু দারদা (রা.) এর সঙ্গে দেখা করে তাকে এ বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে তাই বললেন, যা আমাকে সাওবান বলেছেন।’ (মুসলিম : ৪৮৮)।
নির্দিষ্ট নফল নামাজের ফজিলতের ব্যাপারেও বহু হাদিসে বলা হয়েছে। নবীপত্মী উম্মে হাবিবা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, তিনি নবীজিকে (সা.) বলতে শুনেছেন, ‘যেকোনো মুসলমান বান্দা আল্লাহর জন্য প্রতিদিন ১২ রাকাত নফল নামাজ পড়বে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করবেন।’ (মুসলিম : ৭২৮)। এ ১২ রাকাত নামাজ হলো, জোহরের ফরজের আগে চার রাকাত, পরে দুই রাকাত, মাগরিবের পরে দুই রাকাত, ইশার পর দুই রাকাত এবং ফজরের ফরজ নামাজের আগে দুই রাকাত। কোনো কোনো বর্ণনায় জোহরের পরে চার রাকাত এবং আসরের আগে চার রাকাতের ফজিলতের কথাও বলা হয়েছে।
হজরত বেলাল (রা.)-কে নবী (সা.) লক্ষ্য করে বললেন, হে বেলাল, ইসলামে তোমার কৃত আমল সম্পর্কে আমাকে অবহিত কর। কেননা আমি জান্নাতে তোমার পায়ের ধ্বনি আমার আগে শুনেছি। হজরত বেলাল (রা.) বললেন, আমি আশা রাখতে পারি এমন কোনো আমল করিনি। হ্যাঁ, দিনেরাতে যখনই অজু করি, তখন অজুর সঙ্গে দুই রাকাত নফল অবশ্যই পড়ে নিই।’ (বুখারি)।
নফল নামাজের নিয়ত : নফলকে যেহেতু সুন্নতও বলা হয়। তাই নিয়তে সুন্নতও বলা যাবে, নফলও বলা যাবে। সুন্নত-নফল কিছু না বললেও অসুবিধা নেই। আর নফল নামাজে দুই রাকাত করে নিয়ত করা উত্তম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রাতদিনের (নফল) নামাজ দুই দুই রাকাত।’ (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ১২১০)। এক সালামে রাসুল (সা.) চার রাকাত নফল পড়েছেন বলে প্রমাণ মেলে না। নফল নামাজ নিয়ত করে ছেড়ে দিলে পরবর্তীতে কাজা করতে হবে।
নফল নামাজের কেরাত : নফল নামাজে যেকোনো সুরা-কেরাত পড়ার অবকাশ আছে। এতে সুরার তারতিব বা ধারাবাহিকতা ধরে রাখাও জরুরি নয়। কেরাত আস্তে পড়তে হয়। তবে রাতের নামাজে জোরে পড়ারও সুযোগ আছে।
নফল নামাজ পড়ার স্থান : বাসা-বাড়ি, মসজিদ সব জায়গায় নফল নামাজ পড়া যায়। তবে মসজিদের তুলনায় বাসা-বাড়িতে নফল নামাজ পড়া উত্তম। অবশ্য যে নফল নামাজে জামাতের শর্ত আছে, তা ব্যতিক্রম। যেমন তারাবির নামাজ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ফরজ ব্যতীত উত্তম (নফল) নামাজ হলো ঘরে নামাজ আদায়।’ (বুখারি : ৭৩১)।
নফল নামাজ দাঁড়িয়ে পড়বে না বসে পড়বে : কোনো ওজর ছাড়াও নফল নামাজ বসে বসে পড়া জায়েজ। অবশ্য ওজর ছাড়া বসে পড়লে দাঁড়িয়ে পড়ার তুলনায় সওয়াব অর্ধেক হবে। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) বসে নামাজ পড়া সম্পর্কে নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, ‘বসে নামাজের চেয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া উত্তম। বসে নামাজ পড়লে দাঁড়িয়ে নামাজের চেয়ে অর্ধেক সওয়াব হবে এবং ঘুমিয়ে নামাজ পড়লে বসে পড়ার চেয়ে অর্ধেক সওয়াব হবে।’ (আবু দাউদ : ৯৫১)।
দাঁড়িয়ে নফল শুরু করে বসে পড়া কিংবা বসে শুরু করে দাঁড়িয়ে বাকিটা শেষ করা যাবে। তবে উত্তম হলো যেভাবে শুরু করা হয়েছে সেভাবে শেষ করা। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ২/৩৮৯)।
বাহনে নফল নামাজ : বাস, গাড়ি, ঘোড়া, উটসহ যেকোনো বাহনে বসে বসে ইশারা করে নফল নামাজ পড়া যাবে। ফরজ নামাজে এ ধরনের সুযোগ নেই। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজিকে (সা.) সব দিকে ফিরে বাহনে থাকাবস্থায় নামাজ পড়তে দেখেছি। তবে সেজদা দুটিতে তিনি রুকুর তুলনায় একটু বেশি ঝুঁকতেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ২৫২১)।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ফরজের পাশাপাশি অধিক পরিমাণে নফল নামাজ পড়ে তাঁর প্রিয়ভাজন হওয়ার তাওফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন