শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অধিকাংশ মামলায় হারছে দুদক

দেড় দশকেও হয়নি নিজস্ব প্রসিকিউশন

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

অধিকাংশ আইনি লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই হারের মাত্রা বিচারিক আদালতে ৫৩ ভাগ, উচ্চ আদালতে ৯৫ ভাগ। নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকায় দুদক হেরে যাচ্ছে বলে জানান বিশ্লেষকরা। তবে অধিকাংশ মামলায় হেরে গেলেও প্যানেল আইনজীবীদের কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেনি সংস্থাটি। দুদক বিষয়টির সমাধান কখনও ‘ব্যয় সাপেক্ষ’ এবং কখনও ‘টেকনিক্যাল অসুবিধা’ বলে এড়িয়ে চলছে। বিচারিক এবং উচ্চ আদালতে কোথায় কতজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হবে- তাদের মানদন্ড কি হবে- এমন একটি নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা চলে। তবে সেটিও এখন অনুসৃত হয় না বলে জানা গেছে।

তথ্যানুসন্ধান জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪’র ৩৩ ধারায় দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিটের কথা বলা হয়েছে। আইনটির (১) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কমিশন কর্তৃক তদন্তকৃত এবং স্পেশাল জজ কর্তৃক বিচারযোগ্য মামলাগুলো পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে কমিশনের অধীন উহার নিজস্ব একটি স্থায়ী প্রসিকিউশন ইউনিট থাকিবে।’ প্রতিষ্ঠার দেড় দশকেও দুদক আইনের এ ধারাটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৭ বছরে ৫টি কমিশন গঠিত হলেও কোনো কমিশন আইনের এ অংশটি কার্যকর করেনি। যখনই নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ উঠেছে, তখনই ‘টেকনিক্যাল অসুবিধা’র কথা বলে কমিশন উদ্যোগ গ্রহণ থেকে নিবৃত থেকেছে। অথচ দুদক আইনের সংশোধনীতে বেশকিছু ধারা বাদ দেয়া হলেও বাতিল করা হয়নি ৩৩ ধারা। একদিকে ধারা বহাল রাখা এবং অন্যদিকে ধারাটি কার্যকর না করাকে দুদকের ‘বৈপরিত্ব’ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দুদক সূত্র জানায়, নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী প্রথম ১০ বছরে দুদক ৩ হাজার ৬শ’ ৬২টি মামলা দায়ের করেছে। কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রথম ১০ বছর বিচারের জন্য আদালতে উঠেছে ৩ হাজার ৭শ’ ১২টি মামলা। এসব মামলায় বিভিন্ন আদালতে দুদকের পক্ষে আইনি লড়াই করছেন ৩১৬ জন আইনজীবী। এর মধ্যে ঢাকার বিশেষ আদালতে ১৩ জন, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে ৩৯ জন এবং অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হিসেবে রয়েছেন ৭ জন। তাদের সঙ্গে দুদকের মামলাভিত্তিক (কেস টু কেস) চুক্তি। অর্থাৎ মামলা অনুসারে তাদের ফি বা অর্থ পরিশোধ করা হয়।

সূত্র মতে, ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে প্যানেল আইনজীবীদের ফি বাবদ ব্যয় হয় ৩ কোটি ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৩ টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫ হাজার ৩৯০ টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে আইনজীবীদের দেয়া হয় ৪ কোটি ৬২ লাখ ৯৭ হাজার ৭২১ টাকা। বছরে গড়ে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ কোটি টাকা। যা দুদকের বার্ষিক বাজেটের প্রায় অর্ধেক। বিপুল অর্থ ব্যয় করেও ২০১১ সালে বিচারিক আদালতে দন্ডিত হয়েছেন ২০ শতাংশ আসামি। যদিও বিগত কমিশন দাবি করে অধিকাংশ মামলায় আসামির সাজা হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থ পাচার মামলায় সাজার হার শতভাগ। অথচ এই পরিসংখ্যানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কারণ এসব শুধু বিচারিক আদালতের ফলাফল। হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগে দুদক কয়টি মামলায় জয় পেয়েছে- সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া, মামলাগুলো পূর্ববর্তী কমিশনের আমলে দায়েরকৃত। বাস্তবতা হচ্ছে, বিচারিক আদালতে দুদকের পরাজয়ের অনুপাত ৮০ থেকে ৫৩ শতাংশ। বিচারিক আদালতের এ পরিসংখ্যান দিয়ে দুদক সাফল্যের সাফাই গাইলেও হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগে কত শতাংশ শাস্তি বহাল থাকছে- সেই পরিসংখ্যান বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয় না।

গত দেড় দশকে আবুধাবির সাবেক রাষ্ট্রদূত নাজিম উল্লাহ চৌধুরী ও বনখোকো ওসমান গনি (তিনি আপিল করেননি) ছাড়া কারো শাস্তি বহাল থাকার কোনো তথ্য দুদকের হাতে নেই। ফলে আপিল বিভাগে দুদকের পক্ষে দন্ড বহাল থাকার হার প্রায়শূন্য। বিচারিক আদালত থেকে উচ্চতর আদালত পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কোনো কারণ কমিশনকে লিখিতভাবে কখনো ব্যাখ্যা করতে হয়নি আইনজীবীদের। প্যানেল থেকে বাদ দেয়াই হচ্ছে এ পর্যন্ত দুদক আইনজীবীদের ‘সর্বোচ্চ জবাবদিহিতা’।

সূত্রমতে, বিচার আদালতে এমন আইনজীবীর ওপর দুদককে নির্ভর করতে হচ্ছে যাদের নৈতিকতা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। অর্থ পাচার মামলায় ‘পলাতক’ তারেক রহমানের খালাস প্রাপ্তি, হলমার্ক মামলায় আসামি জেসমিন ইসলামের জামিন মঞ্জুর, ডিএন স্পোর্টসের মালিক পলাতক মোতাহারউদ্দীন চৌধুরী ও ফাহমিদা আক্তার শিখার জামিন লাভের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলায়ও দুদকের প্যানেল আইনজীবীদের বিরুদ্ধে রয়েছে আসামির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ।

সূত্র জানায়, গত দেড় দশকে দুদক রাজনৈতিক আনুগত্য, ব্যক্তি সম্পর্ক, তদবির ও অনুরোধের ভিত্তিতে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে। সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও যোগ্যতার মানদন্ড থেকেছে উপেক্ষিত। কয়েকজন পেশাদার, প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী ছাড়া দুদকের অধিকাংশ আইনজীবীর সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সরকারামলে দুদক হত্যা মামলার আসামিকেও প্যানেলের আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। ওই আইনজীবী এখনো বহাল রয়েছেন। প্রকাশ্যে দুদকের পক্ষে, নেপথ্যে আসামিপক্ষের হয়ে লড়ছেন- এমন একাধিক অভিযোগ সত্তে¡ও সংশিষ্ট আইনজীবীকে প্যানেল থেকে বাদ দেয়া হয়নি। আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের সুবিধা অনুযায়ী শুনানিতে বার বার তারিখ চাওয়া, আদালতে দুদকপক্ষীয় সাক্ষীকে অনুপস্থিত দেখানো, জামিনে জোরালো বিরোধিতা না করা, রেকর্ডপত্র উপস্থাপন না করার মতো অভিযোগ প্রায়ই আসে।

সূত্রমতে, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠনে সবগুলো কমিশনই ‘টেকনিক্যাল সমস্যা’র কথা বলে অনিহা দেখিয়ে আসছে। নিজস্ব ইউনিট গঠন না করার পক্ষে কিছু যুক্তিও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, দুদকের প্রসিকিউশন ইউনিটে ভালো কোনো আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। যদি পিএসসি’র মাধ্যমে এখানে আইনজীবীদের নিয়োগ দেয়া হয়, তারা দুদকের নির্ধারিত বেতন কাঠামোয় চাকরি করবেন না। চাকরিজীবী হওয়ায় তারা আদালতে আইনজীবী হিসেবে অন্য মামলাও পরিচালনা করতে পারবেন না। ফলে এখানে পেশাদার আইনজীবীদের পাওয়া সম্ভব নয়।

তবে এ যুক্তিকে ‘খোড়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন দুদকের কয়েকজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। তাদের মতে, এ সমস্যার সমাধান রয়েছে আইনের ৩৩ (২) উপ-ধারায়। সেখানে প্রসিকিউটরদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী বিধি দ্বারা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। গত দেড় দশকে দুদক একটি বিধিও প্রণয়ন করেনি। আইন ও বিধির আওতায় কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে ১৭ বছরে তাদের বিশেষায়িত কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিক্ষিত করতে পারত। গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ক্ষমতা দিলে দুদকের সহকারী পরিচালক কিংবা উপ-পরিচালকের মর্যাদায় দুদকের আইন কর্মকর্তা সরাসরি মামলা পরিচালনা করতে পারেন। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো এভাবে কিছু মামলা পরিচালনা করত।

অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, ১৯৪৭ সনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে টিসি (ট্রাইব্যুনাল কেস) মামলা হতো সরাসরি জজকোর্টে। এটি তখন ‘আমল-অযোগ্য’ অপরাধ ছিল। বাদী হতেন দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সহকারী কিংবা উপ-পরিচালক। পিএসও পদবির ওই কর্মকর্তা (প্রসিকিউটিং এন্টিকরাপশন অফিসার) নিজেই পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে শুনানি করতেন। ব্যুরোর পক্ষে কোনো আইনজীবী থাকতেন না। একইভাবে দুদক প্রসিকিউটিং অফিসারকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ক্ষমতা দিলে প্রসিকিউশন ইউনিটের কর্মকর্তাই দুদকের হয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। বিশেষ কোনো মামলার ক্ষেত্রে হয়তো সিনিয়র আইনজীবীর শরণাপন্ন হওয়া যেত।
এ বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মঈদুল ইসলাম বলেন, ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সরকার একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেটি পরে এগোয়নি। সেটি হলে দুদকও সেটি অনুসরণ করতে পারত। যখন যার জমানা আসবে- তার পছন্দের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ রাখার জন্যই হয়তো দুদকও নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করছে না। আন্তরিকভাবে চাইলে এটি অবশ্যই সম্ভব। নিজস্ব প্রসিকিউশন না থাকায় দুদক বিচারের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফলাফল আনতে পারছে না- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হকের কাছে শনিবার সন্ধ্যায় জানতে চাইলে- এ বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন