শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ওলিয়ে কামেল হযরত মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ.

প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ওবাইদুল্লাহ উবাইদ

॥ এক ॥
মানবজাতিকে আশরাফুল মাখলুখাত তথা সৃষ্টির সেরা বলা হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর অনেক বিশাল। তবে অল্পতে বলে রাখি, এ জাতিকেই দয়াময় আল্লাহ তাঁর মনোনীত ধর্ম ইসলাম দান করেছেন। কেবল মানুষই নবী, রসূল, কুতুব, আবেদ, ওলি হওয়ার সৌভাগ্যতা অর্জন করতে পারে। আল্লাহর নৈকট্যতা লাভ করা, অতীব প্রিয়বান্দা হওয়া একমাত্র মানুষেরই কর্ম। বাছাইকৃত উন্নত সব কাজ মানবজাতিরই সাজে। সে কারণেই এ জাতি সবার সেরা আশরাফুল মাখলুকাত। বাকি পুরো সৃষ্টিজগত, লালন, সংরক্ষণ সব মানবসেবায়ই নিয়োজিত।
সৃষ্টিজগতকে এ কারণেই সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে যথাযথভাবে মানবজাতির সেবা করে। আর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বা দাসত্ব করার জন্য (সুরা, জারিয়াত, আয়াত ৫৬)। কিন্তু সবার ভাগ্যে কি এ মূল্যবান কাজ জুটবে? হতভাগার একটা দল তো অবশ্যই থাকবে। তেমনি থাকবে একটা সঠিক পথে সঠিক রথে চলনেওয়ালা একটা দলও। সব যুগেই ছিল। প্রেমের নবী প্রিয়নবী (সা.) তাঁর পবিত্র জবানে বলেন, ‘‘আমার উম্মতের একটি দল কিয়ামত পর্যন্ত দীনের উপর অবিচল থাকবে (কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি তাঁদের এ পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না)।’’ (মিশকাত শরিফ) তাঁরা ঈমান, ধর্মে দৃঢ়তা, খোদার দাসত্ব স্বীকার, নৈতিকতায় এক অনন্য নজির হবে। সময়ের বাঁকে বাঁকে তাঁদের আগমন ঘটে। তাঁদেরই একজন বিংশ শতাব্দীর আলোকোজ্জ্বল উদ্ভাসিত প্রদীপ্ত নক্ষত্র, গাংগুহি সিলসিলার আলোড়িত ব্যক্তিত্ব কালজয়ী, ক্ষণজন্মা, মহাপুরুষ, আরিফে রব্বানি, মুর্শিদে আজম আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.)।
তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, বাবুনগর এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাফল্যম-িত বর্ণাট্য জীবনের বিশালত্ব এতই বিস্তৃত যা লেখে বলে শেষ করা মুশকিল। তিনি শাইখুল মাশায়িখ হযরত জমির উদ্দিন (রহ.)-এর সুযোগ্য অনুসারী (মুরিদ) এবং হযরত মুফতি আজিজুল হক সাহেব (রহ.)-এর বিখ্যাত খলিফাদের অন্যতম একজন। তিনি দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুফি আজিজুল হক (রহ.)-এর গর্বিত সুযোগ্য পুত্র। তাঁর বংশ জ্ঞানগরিমা ও মর্যাদা-সম্মানের এক উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা গেছে তাঁদের শুভাগমন আরব দেশ থেকে। এ বংশটি সর্বদা দীনি জ্ঞানের মর্যাদাবান কাজ-কারবারে লিপ্ত থাকে। যা আজও সত্যায়িত। তার বড় ভাই হযরত আমিন (রহ.) একজন তেজস্বী আলেমে দীন। যিনি দীর্ঘদিন যাবত সফলতার সাথে জামিয়া বাবুনগরে শাইখুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আরেক বড় ভাই প্রথম যুগের আধ্যাত্মিক গুরুদের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। হযরত আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.) তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু জমির উদ্দিন সাহেব (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা হওয়া এবং নিজের আত্মচাহিদার বৈপরীত্যতা তাঁকে সে যুগে ‘বুজুর্গ সাব’ নামেই খ্যাত করে তুলে। নামের চেয়ে উপাধিই বেশি প্রসিদ্ধ ছিল। হযরত বাবুনগরী সাহেব (রহ.)-এর সন্তানসন্ততি, ভাইয়ের সন্তান, নাতিপুতি, জামাতাগণের প্রায় সবাই-ই বিজ্ঞ তেজস্বী আলেম ছিলেন।
শিক্ষা-দীক্ষা ও ইলমে লাদুনি (খোদা প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান) হযরত বাবুনগরী (রহ.) নিজেই বর্ণনা করে বলেন, ‘তৎকালে আব্দুল বারী চৌধুরীর বাড়ির পূর্বপার্শ্বে একটি প্রাইমারি ইস্কুল ছিল। আমি সেখানেই প্রাথমিক তথা প্রাইমারি শিক্ষা সমাপ্ত করি। তখনকার ইস্কুলে বর্তমান-সময়ের মতো অশ্লীলতা বলতে কিছুই ছিল না। শিক্ষা সিলিবাসে ধর্মীয় শিক্ষার খুবই গুরুত্ব ছিল। এমনকি জগৎ বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সুফি সম্রাট হযরত শেখ সাদি (রহ.)-এর গ্রন্থনাকৃত গুলিস্তাও পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে করে বাল্যকাল থেকেই ছাত্ররা নৈতিক, শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ নিয়েই গড়ে উঠত।’
ইস্কুলে পড়াকালীন সময়েই আপন পিতার কাছে পবিত্র ঐশীগ্রন্থ কোরআন মাজিদের শিক্ষা অর্জন করেন। তারপর ফটিকছড়ি নছিরুল ইসলাম নাজিরহাট বড় মাদ্রাসায়ও পড়ালেখা করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা সুফি আজিজুর রহমান (রহ.) শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সেখানে তিনি সফলতা ও সুনামের সাথে কাফিয়া পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেন। ১৩৪১ হিজরি সনের মুহাররম মাসের সাত তারিখ চট্টলার ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হন। পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনি দাওরা (টাইটেল) পর্যন্ত পড়ালেখা করতে সক্ষম হননি। তিনি মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় সফলতা, সুনাম ও কীর্তিত্বের সাথে জামাতে উলা তথা মিশকাত শরিফ পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর আপন বড় ভাই হযরত আমিন সাহেবের কাছে সিহাহ সিত্তার (ছয় বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ) শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু তাঁর তাত্ত্বিক বক্তব্য, বিশুদ্ধ বয়ান, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, ধর্মীয় বিধি-বিধান বর্ণনা ও গভীরধ্যানী আলোচনায় কখনো এটা বুঝা যেত না যে, তিনি দরসে নিজামির সিলিবাসের শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে লাভ করেননি। তাঁর বয়ানের সময় মঞ্চে বহু বড় আলেম-ওলামা উপস্থিত থাকেন। তারা বাবুনগরীর গাম্ভীর্য আলোচনা খুব মনোযোগী হয়ে শুনেন। কেউই মজলিশ থেকে নড়াচড়া বা উঠাওঠি করতেন না। তাঁর বহুমুখী জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় বহু ইসলামী চিন্তাবিদ আশ্চর্যের বশে হয়রান হয়ে যেতেন। এবং বাবুনগরীর আলোচনা থেকে তাঁরাও উপকৃত হতেন। তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য একাডেমিক শিক্ষা না থাকার পরেও এভাবে তথ্যপুঞ্জি ভরপুর আলোচনা করতে পারাটাই ইলমে লাদুনি তথা খোদা প্রদত্ত জ্ঞানের নিদর্শন।
খতিবে আজম হযরত মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব তাঁর চাক্ষুষ প্রত্যক্ষিত একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘একবার মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে শাইখুল মাশায়েখ জমিরউদ্দিন (রহ.); হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেব (রহ.); হযরত মাওলানা সাইদ আমদ সাহেব (রহ.); হযরত মুফতিয়ে আজম মাওলানা মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেব ও দেউবন্দের একজন বরেণ্য আলেমসহ দেশের খ্যাতিমান ওলি-বুজুর্গরা মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। হযরত হাবিবুল্লাহ (রহ.) হযরত হারুন বাবুনগরী (রহ.)কে ডেকে পাঠান। এবং তিনি মঞ্চে উপস্থিত হলে মহারথীদের সামনেই বলেন, ‘বয়ান পেশ করো।’ তখন আল্লামা হারুন বাবুনগরী সাহেব উঠতি বয়সেরই ছিলেন। নওজোয়ান। আমরা সবাই আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম যে, এতগুলো মুদাররিসে আওয়াল (প্রধান শিক্ষক মহোদয়)-এর উপস্থিতিতে হাবিবুল্লাহ সাহেব একজন নওজোয়ানকে কেনই বা বক্তব্য দিতে বলছেন! এতে নিশ্চয়ই কোনো হেকমত (কল্যাণকরী রহস্য) অবশ্যই আছে। আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.) গৌরবান্বিত জীবন এখন সে উত্তর বলে দেয়। আর সেটা বিখ্যাত হক্কানি আলেমদের ওয়াজের সমষ্টিগত একটি অনুমোদনও বটে।
পরবর্তী সময়ে বাবুনগরী (রহ.) ঘন-বয়ানের মাধ্যমে, কীভাবে দীনের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন, তা পুরো পৃথিবী দেখে নিয়েছে। তৎকালে চট্টগ্রাম পটিয়া মাদ্রাসায় বাৎসরিক জলসায় বক্তাদের জন্য সময় নির্ধারণ করা থাকলেও বাবুনগরী (রহ.)-এর জন্য কোনো সময়ের নির্দিষ্টতা ছিল না। অন্যান্য বক্তাদেরকে সময় শেষ হলে ইশারা করে বক্তব্য শেষ করতে বললেও বাবুনগরী (রহ.) ক্ষেত্রে এমন কিছুই হতো না। হযরতের ইচ্ছেমত সময় নিয়ে বয়ানের অনুমতি ছিল।’ খতিবে আজম খ্যাত সিদ্দিক আহমদ সাহেবের বাড়ির মসজিদে একদা ওয়াজের প্রোগ্রাম হয়। সেখানে বাবুনগরী (রহ.) উপস্থিত হলে খতিবে আজম সাহেব নিজের এলাকার লোকেদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আজকাল পীরের হক্কানিয়ত, সত্যতা, নিষ্ঠাপরায়ণতা যাচাই-বাছাই করা খুব কঠিন ব্যাপার। সিংহভাগ মানুষ পীর অনুসরণ করতে গিয়ে ভুলের শিকার হচ্ছেন। ভুল পথে প্রদর্শিত হচ্ছেন। আমি অত্যন্ত যাচাই-বাছাই করে আপনার জন্য পীর নিয়ে এসেছি। তিনি হচ্ছেন হযরত মাওলানা হারুন সাহেব (রহ.)। তিনি হযরত মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা। তিনি শাইখুল মাশায়েখ জমির উদ্দিন (রহ.)-এরও খলিফা।
হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রহ.)-এরও খলিফা। তিনি হযরত মাওলানা সুফি আজিজুর রহমান সাহেব (রহ.)-এরও খলিফা। এবং তিনি হযরত মুফতি আজম ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এরও খলিফা।’ মূলত খতিবে আজমের উদ্দেশ্য ছিল এ কথাটা বোঝানো যে, তিনি তৎকালের ক্ষণজন্মা আলেম-বুজুর্গদের চোখের মণি ছিলেন। অতীব প্রিয়পাত্র ছিলেন। কারণ মাঠে-ময়দানে ওয়াজ-নসিহত করার জন্য তিনি সকলের কাছ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। খতিবে আজম সাহেব অত্যন্ত আবেগজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন। খতিবে আজম সাহেব আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রীও হযরত বাবুনগরী (রহ.)-এর একজন ভক্ত ও অনুসারিণী।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন