মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

হিডেন সার্ভিস চার্জের নামে ব্যাংকের প্রতারণা

প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ব্যাংকগুলোর মূল বিনিয়োগ হচ্ছে গ্রাহকদের আমানত। গ্রাহকরা ব্যাংকে টাকা জমা রাখে আর্থিক নিরাপত্তা ও কিছু লাভের জন্য। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ দিয়েই ঋণ দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে। প্রতিটি ব্যাংকই তাদের একাউন্টে অর্থ জমা রাখার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করে গ্রাহকদের আকর্ষণ করে থাকে। গ্রাহকরাও এসব সুযোগ-সুবিধায় প্রলুব্ধ হয়ে পছন্দের ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করতে আগ্রহী হয়ে উঠে। অর্থ জমা রাখার পর দেখা যায়, অধিকাংশ ব্যাংক সার্ভিস চার্জ, এসএমএস পাঠানোর খরচসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ কেটে রাখছে। অনেকটা গোপনে এসব চার্জ কেটে রাখা হচ্ছে। এতে ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকদের যে লাভ বা সুদ দেয়া হয়, তার বড় একটা অংক এ হিডেন চার্জ বাবদ চলে যাচ্ছে। গ্রাহকরা যখন দেখে তাদের অর্থ থেকে বিরাট একটি অংশ কেটে রাখা হয়েছে, তখন ব্যাংকের কাছে জানতে চাইলে তারা নয়-ছয় বুঝিয়ে তাদের মতো করে একটি হিসাব দিয়ে দেয়। গ্রাহকরা সন্তুষ্ট না হলেও তাদের কিছুই করার থাকে না। ব্যাংকগুলোর এমন স্বেচ্ছাচারী আচরণের শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রায় ৫৬টি ব্যাংক সার্ভিস চার্জের নামে গোপনে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ লুটে নিচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৮ থেকে ১০ রকমের গোপন চার্জ কাটা হচ্ছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো কৌশলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এতে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাংক থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাবে।
ব্যাংক একাউন্ট খোলার সময় সার্ভিস চার্জের পরিমাণের কথা কোথাও উল্লেখ থাকে না। আবেদন পত্রে শুধু যে সেবা গ্রাহক গ্রহণ করবে তার পাশে টিক চিহ্ন দেয়ার কথা বলা হয়। অথচ গ্রাহক অর্থ জমা রাখার পর ব্যাংকগুলো একের পর এক সার্ভিস চার্জ কাটতে থাকে। দেখা যায়, যেসব ক্ষুদ্র আমানতকারী অর্থ জমা রাখেন, বছর শেষে তাদের লাভ দূরে থাক, মূল অর্থ আরও কমে যায়। আমানতকারী যদি পুনরায় একাউন্টে টাকা জমা না করেন, তবে আগের যে অর্থ জমা করেছিলেন সার্ভিস চার্জ কাটতে কাটতে তা শূন্য হয়ে যায়। অর্থাৎ আমানতকারীর পুরো অর্থই লোপাট হয়ে যায়। গোপনে সার্ভিস চার্জ কাটার মাধ্যমে আমানতকারীর অর্থ মেরে খাওয়া অধিকাংশ ব্যাংকের একটি প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক ব্যাংক লাভজনক না হলেও ভাল চলছে। এর অন্যতম কারণ সার্ভিস চার্জের নামে আমানতকারীদের অর্থ মেরে দেয়া। এ ধরনের ব্যাংকিং যে পুরোপুরি প্রতারণাপূর্ণ তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। শুধু তাই নয়, গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হচ্ছেন। ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে গেলে জমাকৃত অর্থের উপর প্রদেয় সুদের হার সবচেয়ে কম ধরা হয়। অন্যদিকে ঋণ নিতে গেলে একজন গ্রাহককে তার দ্বিগুণ সুদ দিতে হয়। এর উপর রয়েছে গোপন চার্জের খড়গ। একটি ঋণ অনুমোদনে ১১ শতাংশ সুদের কথা উল্লেখ করা হলেও এটি ওভার ডিউ হলে মূল সুদের সঙ্গে আরও ১ থেকে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ যুক্ত করা হয়। গ্রাহককে না জানিয়েই ব্যাংকগুলো এ কাজ করছে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলো নিজ স্বার্থে গ্রাহককে তথ্য জানাতে গিয়ে যে এসএমএস পাঠায়, তার খরচও গ্রাহকের অর্থ থেকে কেটে নিচ্ছে। প্রতি মাসে কারেন্ট একাউন্ট স্টেটমেন্ট সরবরাহ ফি নেয়ার কোনো বিধান না থাকলেও গোপনে তা কেটে নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া এজেন্ট ও এটিএম বুথ থেকে অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে যে চার্জ দিতে হয়, তা মাত্রাতিরিক্ত। প্রতি মাসে গ্রাহকদের হিসাব নেয়া সম্ভব না হওয়ার সুযোগে ব্যাংকগুলোর সার্ভিস চার্জের নামে গোপনে অর্থ লুটে নিচ্ছে। হিডেন চার্জ ব্যাংকগুলোর আয়ের অন্যতম একটি উৎসে পরিণত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহকরা। ব্যাংকগুলোর এই স্বেচ্ছাচারী আচরণ এবং গ্রাহকদের জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই।
ব্যাংকিং খাতে হিডেন চার্জের নামে গ্রাহকদের অর্থ কেটে নেয়ার এ অপসংস্কৃতির রাশ টেনে ধরতে না পারলে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এতে গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হয়ে এ খাতের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। অথচ ব্যাংকের সার্ভিস চার্জের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেয়া আছে। এমনকি ব্যাংকগুলোর সেবা চার্জ দৃশ্যমান জায়গায় টাঙ্গিয়ে রাখার নির্দেশনাও রয়েছে। এসব নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই অধিকাংশ ব্যাংক হিডেন চার্জের নামে গ্রাহকদের অর্থ লোপাট করে চলেছে। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ব্যাংক হিডেন চার্জের মাধ্যমে আমানতকারীদের আমানত তসরুপ করে চলেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকগুলোর সার্ভিস চার্জ আমানতকারীদের জানানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো ধরনের গোপন চার্জ ধার্য্য করা যাবে না। ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এর বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, গ্রাহকদের অর্থের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন