শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী সংখ্যা

স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার

শেখ হাসিনা | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

ধানমন্ডির ৩২নং বাড়ি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি মিউজিয়াম হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। কাজ চলছে। মিউজিয়াম করতে গেলে অনেক পরিবর্তন করতে হয়। সে পরিবর্তন কমিটি করাচ্ছে। আমি প্রায়ই যাই দেখতে। দেয়ালগুলিতে যখন পেরেক ঠোকে, জিনিসপত্রগুলি যখন সরিয়ে ফেলে বুকে বড় বাজে, কষ্ট হয় দুঃখ হয়। মনে হয় ঐ পেরেক যেন আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। মাঝে মাঝেই যাচ্ছি, ঘুরে দেখে আসছি যতই কষ্ট হোক। এই কষ্টের মধ্যে ব্যথা-বেদনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। সে আনন্দ হল আমরা জনগণকে তাদের প্রিয় নেতার বাড়িটি দান করতে পারছি। জনগণের সম্পত্তি হবে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি। এটাই আমাদের বড় তৃপ্তি। আমরা তো চিরদিন থাকব না কিন্তু এই ঐতিহাসিক বাড়িটি জনগণের সম্পদ হিসেবে সব স্মৃতির ভার নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকবে। এখানেই আমাদের সান্ত্বনা। আমরা ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর এই বাড়িটিতে আসি। তারপর থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ সভা এই বাড়িতে হয়েছে। এই ১৯৬১ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত কত ঘটনা এই বাড়ি ঘিরে। মাঝখানে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ’৮১ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বাড়ি বন্ধ ছিল। আব্বা শাহাদাত বরণ করার পর ওরা বাড়িটি সিল করে দেয়। তারপর আর কেউ প্রবেশ করতে পারেনি।

মনে পড়ে ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মণি ভাই এই বাড়ি থেকে নিদের্শ নিয়ে যেতেন, পরামর্শ নিতেন। ১৯৬২ সালে আব্বা গ্রেফতার হন। তখনকার কথা মনে পড়ে খুব। আমি ও কামাল পেছনের শোবার ঘরে থাকি, মাঝখানে বাথরুম, তারপরই মার শোবার ঘর। তখনও বাড়িটি সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা যখন এ বাড়িতে এসে উঠি, তখন কেবল দুটো শোবার ঘর আর মাঝের বসার ঘরটা হয়েছে। ওর অর্ধেকটায় খোকা কাকা, স্নো ভাই, মণি ভাইসহ অনেক আত্মীয়স্বজন থাকত। মাঝখানে পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা বসার ঘর তখনও অসমপ্ত। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, দেখি বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি, তার মধ্যে পুলিশ। জানালার পাশে একজন দাঁড়িয়ে আর একজন অত্যন্ত সতর্কভাবে গুটি শুটি পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি পর্দার পাশে, ঘর অন্ধকারই, তাই আমাকে দেখতে পায়নি। তাড়াতাড়ি কামালের খাটের কাছে গেলাম। ওকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে চেষ্টা করলাম। ও চোখ খুলল, ‘হাস্পা কি?’

আমি বললাম, ‘পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।’ এ কথা বলেই তাড়াতাড়ি বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে মাকে ডাকলাম। মা ও আব্বা যখন টের পেয়ে গেছেন। মা বললেন, ‘তোমার আব্বাকে ওরা অ্যারেস্ট করবে।’ ঐ বাড়ি থেকেই আব্বাকে বন্দি করে নিয়ে গেল। প্রায় পাঁচ ছয় মাস আব্বা জেলে থাকেন।

১৯৬৪ সালের অক্টোবরে রাসেলের জন্ম। তখনও বাড়ির দোতলা হয়নি, নিচতলাটা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোণে আমার ঘরেই রাসেলের জন্ম হয়। মনে আছে, আমাদের সে কি উত্তেজনা। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা, খোকা কাকা অপেক্ষা করে আছি। বড় ফুফু, মেজ ফুফু তখন আমাদের বাসায়। আব্বা তখন ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচার কাজে। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করা হয়েছে সর্বদলীয়ভাবে। বাসায় আমাদের একা ফেলে মা হাসপাতালে যেতে রাজি না। তাছাড়া এখনকার মতো এত ক্লিনিকের ব্যবস্থা তখন ছিল না। এসব ক্ষেত্রে ঘরে থাকারই রেওয়াজ ছিল। ডাক্তার-নার্স সব এসেছে। রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। ছোট্ট মানুষটা আর কত জাগবে। জামালের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু, তবুও জেগে আছে কষ্ট করে নতুন মানুষের আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধল। যুদ্ধের পূর্বে ১৯৬৪ সাল ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হলো। দাঙ্গায় বহু মানুষকে এ বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হল। দেশে শান্তি স্থাপনের এবং দাঙ্গা থামাবার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে পরিশ্রম করলেন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনলেন। এটা ছিল সরকারের একটা চাল। সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেবার এক কৌশল। এখনও ঐ একই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কত ঘটনা যে মনে পড়ে। এই বাড়ি যখন তৈরি হয়, ইট ভেজানোর জন্য পানির হাউজ তৈরি করা ছিল। চাচি হেলাল, মিনাকে নিয়ে ঢাকায় এলেন। রেহানা, জামাল, হেলাল, মিনা সারাদিন বারান্দায় খেলা করত।

আমি বারান্দায় মোড়ায় বসে বই পড়ছি আর হেলাল বারান্দায় রাখা কাঠের দরজা-জানালায় পাল্লার স্তূপের উপর বসে খেলছে। একবার নামছে, একবার উঠছে। এর মধ্যে হঠাৎ ও হাততালি দিয়ে উঠল ‘মিনা সাঁতার কাটে, মিনা সাঁতার কাটে’ বলে- জামাল দেখল, মিনা হাউসে পড়ে গেছে। হাউসে নেমে মিনাকে টেনে তুলল। আমি ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে এলাম, বেশি পানি খায়নি, তবে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বড় একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেল। মিনা আমাদের সবার অত্যন্ত আদরের। আব্বা ওকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তিনি এই খবর শুনলেই আমাদের উপর দিয়ে যে কি যাবে ভাবতেও পারছি না।

১৯৬৬ সালের কথা মনে আছে। কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভা চলছিল। আমার তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথম বর্ষের কয়েকটা বিষয়ের পরীক্ষা, যার নম্বর দ্বিতীয় বর্ষে যোগ হবে। কিন্তু পড়ব কি! মিটিং চলছে বাড়িতে, মন পড়ে থাকে সেখানে। একবার পড়তে বসি আবার ছুটে এসে জানালার পাশে বসে মিটিং শুনি। সবাইকে চা বানিয়ে দেই। যাক সেসব। বিকেলে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা হয় ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। আব্বার ফিরতে বেশ রাত হল।

আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে জনসভার গল্প শুনলাম। সেই জনসভায় আব্বাকে ছয় দফার উপর একটা সোনার মেডেল উপহার দেয়া হয়েছিল। রাত বারোটায় আব্বা শুতে বিছানায় গেলেন। আমি পড়তে বসলাম। ঐ বছরই বাড়ির দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজেই দোতলার পেছনের উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার। দক্ষিণের বড় জানালা। আমি খুব জোরে পড়তাম ঘুম তাড়ানার জন্য। এর মধ্যে নিচ থেকে মামার চিৎকার শুনি ‘পুলিশ এসেছে’। বাড়িতে ঢুকতে চায়।

গেটের তালা খুলতে বলে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে মামা দাঁড়িয়ে। আমি পুলিশ অফিসারকে বললাম, ‘আব্বা অনেক রাতে ঘুমিয়েছেন। এখন রাত দেড়টা বাজে, এখন কি করে ডাকব? তাছাড়া সকালের আগে কি করে বন্দি করবেন? আপনারা অপেক্ষা করুন।’ আমি তাদের গেটের বাইরে চেয়ার দিয়ে বসতে বললাম। আর এখন কিছুতেই ডাকতে পারবে না বলে জানালাম। আমি বারান্দা থেকে ঘর পেরিয়ে মাঝের বসার ঘরে এসেছি। শুনি টেলিফোন বাজছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাঝের ঘরের ছোট জানালা খোলা, আব্বা কথা বলছেন টেলিফোনে। ওপার থেকে কী বলছেন শুনছি না, তবে শুনলাম আব্বা বললেন, ‘তোমাকে নিতে এসেছে তবে তো আমাকেও নিতে আসবে।’ আমি জানালার পাশ থেকে বললাম, ‘নিতে আসবে না আব্বা, এসে গেছে অনেক আগে।’ আব্বা উঠে দরজা খুললেন।

ততক্ষণে বাড়ির সবাই জেগে আছে। রাসেল খুবই ছোট্ট। শুধু ও ঘুমিয়ে আছে। দোতলায় চায়ের ঘরে গিয়ে ইলেকক্ট্রিক কেটলিতে চায়ের পানি চাপালাম। চোখের পানি বাঁধ মানে না। মাও চোখের পানি চেপে রাখার চেষ্টা করছেন আর আব্বার কাপড়-চোপড় গুছিয়ে দিলেন, অনেকগুলি এরিনমোর তামাকের কৌটা দিলেন-পরে পাঠাতে অসুবিধা হয় বলে, লেখার জন্য কাগজ, কলম, খাতা সাথে দিলেন। কিছু বইপত্র এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী, মা সব গুছিয়ে দিলেন। আব্বাকে ওরা নিয়ে গেল।

১৯৬১ সালে এই বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কোনমতে তিনটা কামরা করে এসে আমরা উঠি। এরপর মা একটা একটা কামরা বাড়াতে থাকেন। এভাবে ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে দোতলা শেষ হয়। আমরা দোতলায় উঠে যাই। ছয় দফা দেবার পর কাজকর্মও বেড়ে যায়। নিচতলাটা তখন রাজনৈতিক কর্মকান্ডেই ব্যতিব্যস্ত। নিচে আব্বার শোবার কামরাটা লাইব্রেরি করা হয়। ড্রেসিং রুমে সাইক্লোস্টাইল মেশিন পাতা হয়। লাইব্রেরির কামরায় টাইপরাইটার মেশিন। আব্বা আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন বন্দিখানা থেকে মুক্তি পাবার পর। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সব নেতা ‘এবডো’ ছিলেন, অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাই ছাত্রদের সংগঠিত করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়।

আব্বা অবশ্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। সেখানে দলকে সংগঠিত করার কাজ ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য জেলা, মহকুমা, থানায় গোপন সেল গঠন করেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রতি দলকে সুসংগঠিত করার কাজ গোপনে চলতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠছে। ১৯৬২-তে বহু ছাত্র গ্রেফতার হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এ বাড়িতে এসেছে গোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিতে ও আলোচনা করতে। এখন অনেকের অবস্থানই ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্মে বলে আমি কারও নাম নিতে চাই না।

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি আব্বাকে ঢাকা জেলাখানা থেকে বন্দি করে নিয়ে যায়। ১৮ জানুয়ারি আমরা জেলগেটে গিয়ে আব্বার দেখা পাই না, কোথায় নিয়ে গেছে (বেঁচে আছেন কি না তাও জানি না।) ছোট্ট রাসেল, অবুঝ রাসেল কিছুই বুঝে না। ‘আব্বা আব্বা’ করে কেবল কাঁদে। জেলগেট থেকে ফিরে এসে এই বাড়িরে মেঝেতে গড়িয়ে আমরা অনেক কেঁদেছি। এরপর শুরু হল মিথ্যা মামলা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, আব্বাকে ফাঁসি দেবার ষড়যন্ত্র। গর্জে উঠল বাংলার মানুষ। শুরু হল আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান।

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের চাপে আব্বাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হল। সেদিন এই বাড়ির সামনে মানুষের ঢল নেমেছিল। সমস্ত বাড়িই যেন জনতার দখলে চলে যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন মিছিলের পর মিছিল আসতে থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এসে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যেত। আব্বা কখনও গেটের পাশে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে, কখনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। আমরা আব্বার পাশে এসে দাঁড়াতাম, হাজার হাজার মানুষের ঢল নামত তখন এই বাড়ির সামনে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছিল এই বাড়িটি। রাত ১২.৩০ মিনিটে আব্বা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিলেন। আর সেই খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পৌছে দেয়া হল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। এই খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা তা প্রচার শুরু করলেন। এই খবর পাকিস্তানী সেনাদলের হাতে পৌঁছল। তারা আক্রমণ করল এই বাড়িটিকে। রাত ১.৩০ মিনিটে তারা আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আজও মনে পড়ে সে স্মৃতি। লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণের যে দরজা তারই পাশে টেলিফোন সেটটি ছিল ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছেন। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

২৬ মার্চ পুনরায় এই বাড়ি হানাদারবাহিনী আক্রমণ করে। মা, রাসেল, জামাল ও কামাল কোনোমতে দেয়াল টপকিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী বাড়িতে ঢুকে লুটতরাজ শুরু করে। প্রতিটি ঘর তারা লুট করে, ভাংচুর করে, বাথরুমের বেসিন কমোড আয়না সব ভেঙে ফেলে। কয়েকজন সেনা বাড়িতে থেকে যায়- দীর্ঘ নয় মাস ধরে এই বাড়ি লুট হতে থাকে। পাকসেনারা এক গ্রুপ লুট করে যাবার পর আর এক গ্রুপ আসত। সোনাদানা জিনিসপত্র সবই নিয়েছে। আমরা এক কাপড়ে সব বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমার আর মার যে গহনা লকারে ছিল সেগুলি বেঁচে যায় কিন্তু চাবি হারিয়ে যায়।

এই বাড়িটি যখন ১২ জুন, ১৯৮১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের নির্দেশে খুলে দেয়া হল তখন বাড়িটির গাছপালা বেড়ে জঙ্গল হয়ে আছে। মাকড়সার জাল, ঝুল, ধুলোবালি, পোকামাকড়ে ভরা। ঘরগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুলির আঘাতে লাইব্রেরি ঘরের দরজা ভাঙা, বইয়ের আলমারিতে গুলি, কাচ ভাঙা, বইগুলি বুলেটবিদ্ধ, কয়েকটা বইয়ের ভেতরে এখনও বুলেট রয়েছে। একটা বই, নাম ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। বইটির উপরে কবি নজরুলের ছবি, বইটির ভিতরে একখানা আলগা ছবি একজন মুক্তিযোদ্ধার- বুলেটের আঘাতে বইটি ক্ষতবিক্ষত। মুক্তিযোদ্ধার ছবিটির বুকের উপর গুলি। ঠিক ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে এ বাড়িতে যে আক্রমণ হয়, তা হল ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ। এ বইটির দিকে তাকালেই যেন সব পরিস্কার হয়ে যায়। কেন ওরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুকে? মনে হল যেন পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। মায়ের ঘরের আলমারির সব জিনিস বিছানার উপর স্তূপ করা। ঘরের মেঝেতে বড় বড় গুলির আঘাত। দোতলায় মার শোবার ঘর। এই ঘরেই খুকী, রোজী, জামাল, রাসেলকে খুনিরা হত্যা করেছে। মা দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন, মাকে ওখানে গুলি করেছে। আব্বার বিছানার পাশের টেবিলটায় রক্তের ছোপ এখনও শুকিয়ে আছে। পূর্ব দিকের দেয়াল জুড়ে রক্তের দাগ। ছাদের উপর মাথার ঘিলু গোছা গোছা চুলসহ লেগে আছে। এই ঘরেই হত্যাকারীরা ঐ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারপর দুহাতে ঘর লুটপাট করেছে। দোতলায় সিঁড়িতে এখনও রক্তের দাগ রয়েছে। দোতলায় জামালের ঘরের বাথরুমের বড় আয়নাটায় গুলির আগাতে বড় একটা গর্ত হয়ে আছে। আয়ানাটা ভেঙেছে, দোতলার বসার ঘরের পশ্চিম পাশের ঘরটা প্যান্ট্রি ঘরের মতো, ওখানে ইস্ত্রি করার টেবিলট। পাশে ডিনার ওয়াগান, কাচের ও রূপার জিনিসপত্র ভরা, উত্তর দিকে একটা সেলফ যেখানে মায়ের হাতের আচারের বৈয়ামগুলি।

অনেক স্মৃতিভরা ৩২নং সড়কের এই বাড়িটি। বাড়িটি আমাদের থাকবে না। ওটা এখন জনগণের সম্পত্তি। ট্রাস্ট করে জনগণের জন্য দান করে দিয়েছি। আমার আব্বা শুধু তো আমাদের ছিলেন না, তার থেকেও বেশি ছিলেন- জনগণের। আমরা সন্তান হিসেবে তাঁকে যতটুকু পেয়েছি, এদেশের জনগণ তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে। জনগণের কল্যাণে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। আমরা আর কতটুকু তাঁকে কাছে পেয়েছি! তাই এই বাড়িটি এত স্মৃতিভরা, এ ভার বইবার ক্ষমতা আমার নেই, রেহানারও নেই। তাই আজ আমরা আনন্দিত এ বাড়িটি জনগণকে দান করে দিতে পেরে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর করার পরিকল্পনা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের। আমরা আজ গৌরববোধ করতে পারি আমাদের বহু স্মৃতিবিজরিত এই বাড়িটি আজ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রিয় তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। (সংক্ষেপিত)

[গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখাটি ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন