স্টালিন সরকার (পাটগ্রাম থেকে) : ‘ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায়; দামাল ছেলের মতো/ ডাক দে বলে আয়রে তোরা আয়; ডাকবো তোদের কত’। বাংলাদেশের বর্তমানের সবুজ ধান ক্ষেতের চিত্রই যেন উঠে এসেছে কবির এই কবিতায়। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরে গেছে দেশের উত্তরাঞ্চলের ক্ষেত-মাঠ। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত। ফসলের মাঠ সবুজ আর সবুজ। এলোমেলো হাওয়ায় দুলছে ধান ক্ষেত। হাজার হাজার বিঘা জমিতে থোকা থোকা ধান। বাতাসে একই তালে মাথা দুলাচ্ছে। সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবন্ধা, রংপুর, নিলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুর জেলার সর্বত্রই একই চিত্র। নদী বিদৌত এলাকাগুলো ধান ক্ষেতের সবুজ রূপ যেন আরো আকর্ষণীয় অপরূপ। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁত ছবি। কোথাও কোথাও সবুজ ধানের মৌ ধরেছে। আবার মাঝে মাঝে দু’চার বিঘা জমিতে ধানে সোনালী রং। আহা এ কি অপরূপ দৃশ্য বাংলাদেশের মাঠে প্রান্তরে! উঁচু নিচু সমতল সব এলাকায় ধানের একই দৃশ্য। যেন পাহাড়ের চা বাগারে দৃশ্য। বাগানের চা গাছের মাথা একই ভাবে ছেটে ফেলার পর যে রূপ ধারণ করে। কবির ভাষায় ‘মাঠের পর মাঠ চলেছে/ মাঠের নাহি শেষ’। রবীন্দ্র নাথের ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা ও ভাই লুকোচুরির খেলা’ চলছে বাংলাদেশময়।
নিলফামারীর জলঢাকা থেকে ব্যাটারি চালিত ভ্যানে ডালিয়া যেতে বাতাসে ধান গাছের দোল খাওয়া দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোতেই হঠাৎ কানে ভেসে এলো গান ‘ক্ষেতে বাতাসে দুলছে ধানের যৌবন/ ঘরে ঘরে তুলছে যুবতীর পিতা-মাতার মন’। সঙ্গী মশিউর রহমান ইশারা করতেই চোখে পড়লো ক্ষেতে পাকা ধান কাটতে কাটতে আনমনে গান গাইছেন দু’জন ক্ষেতমজুর। আইলে বসে আছেন একজন। ফলন ভাল হওয়ায় তার মুখে হাসির ঝিলিক। এত সুন্দর গান লিখেছেন কে জানতে চাইতেই সঙ্গী জানান, বুঝলেন না ভাই? এটা ক্ষেত মজুরদের বানানো গান। ফলন ভাল হলে তারা মনের সুখে নিজেরাই গান বাঁধেন।
কৃষিপ্রধান এ দেশ। ক্ষেতে ধানের ফলন দেখেই কৃষকরা আগামীর স্বপ্ন বুনছেন। ঘরে ধান আসলে বিক্রি করে কেউ মেয়ে বিয়ে দিবেন, কেউ ছেলের বউ আনবেন ঘরে। বছরের জামা-কাপড়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচের যোগান দেবেন। ধার-দেনা, দাদনের টাকা পরিশোধ করবেন, স্ত্রীর শখ মেটাবেন। প্রকৃতির আশির্বাদ যথা সময়ে বৃষ্টি এবং বন্যার পলি ফেলে যাওয়ায় ধানের গাছ হৃষ্টপুষ্ট হওয়ায় তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।
না, ধান পাকার মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। কৃষকদের ভাষায় আগুর (আগে রোপন করা) ধানে পাক ধরেছে। কিছু পাকা ধান কাটা হচ্ছে। সে ধান কাটার সময় ক্ষেতমজুর মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে কাচি চালাচ্ছে। পাটগ্রামে গরুর গাড়ী, জলঢাকায় ব্যাটারী চালিত ভ্যান ও কুড়িগ্রামে ঘোড়ার গাড়িতে করে ধান নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। উত্তরাঞ্চলের শত শত ধানের মাঠে একই চিত্র।
মহাসড়কে বাস উঠতেই হেমন্ত মুখপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘এ পথ যদি শেষ না হয়’ গানের বিপরীত মেরুতে পড়তে হলো। পথ যেন শেষ হচ্ছেই না। ঢাকা টু রংপুর ৬ ঘন্টার পথ পেরুতে জার্নি করতে হলো ১১ ঘন্টা। পথের খানাখন্দে বাসের লাফানিতে পেটে নাড়িভূড়ি বের হওয়ার উপক্রম। রংপুর কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বাস থামামাত্রই শুরু হলো বৃষ্টি। অগত্যে হোটেল। ভোরে জলঢাকা হয়ে ডালিয়া। পাগলাপীর মোড়ে চোখে পড়লো চমৎকার পাকা রাস্তার দুধারে গাছের সারি। আর যেদিকে চোখ যায় ক্ষেতে সবুজ ধান আর ধান। প্রান্ত থেকে প্রান্তরে সবুজের সমারোহ। জলঢাকার কৈশাল নামের এক প্রভাবশালী কৃষক জানান, এতোদিন যে সব জমিতে তামাক চাষ করা হতো সে গুলোতে এখন থোকা থোকা ধান শোভা পাচ্ছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় ধানের গাছ বেশ পোক্ত। প্রাকৃতির কোনো দূর্যোগ না হলে এবার ধানের বাম্পার ফলন হবে। ধান উৎপাদনে সরকারের সব লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
প্রকৃতি এখন নতুন সাজে। কখনো প্রচ- রোধ কখনো বৃষ্টি। জলঢাকায় অপেক্ষায় থাকা বন্ধু মশিউর রহমানের আতিথ্য গ্রহণের পর আবার পথ চলা শুরু। বন্ধু ব্যাটারী চালিত ভ্যান ভাড়া করলেন। নীরবে চলতে শুরু করলো বাহন। দুই পাশের গাছের সারি। এঁকেবেঁকে চলছে রাস্তা। অপরুপ প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে দেখতে ডালিয়া। রাস্তার পাথে কোথাও কোথাও নতুন ঘর উঠেছে। নদী ভাংগনে বাড়ি-ঘর হারানো মানুষ এসব বাড়ি তৈরি করছেন। ডালিয়ায় তিস্তা সেচ প্রকল্প। এ প্রকল্পটি নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে। সেচ প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রযেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
হায় আল্লাহ! স্বপ্নের ডালিয়া বাঁধের একি হাল! সড়ক তো নয়, খানাখন্দ। মূল প্রকল্প ব্রীজের ফাটল মেরামত করে দুই পার্শ্বে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পিলার তুলে। কারণ কি? স্থানীয়রা জানান, সুইচ গেইট নির্মাণের পর থেকে ব্রীজের ওপর দিয়ে হালকা যানবাহন চলাচল করতো। ভারী যানবাহন চলাচল ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু একজন প্রতিমন্ত্রীর (স্থানীয় এমপি) পুত্রের ক্যারিশমায় হঠাৎ ব্রীজটি যান চলাচলের জন্য ইজারা দেয় উপজেলা প্রশাসন। প্রতিমন্ত্রী পুত্র নামে মাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে যানবাহনের ওপর টোল তোলা শুরু করেন। সাধারণ যানবাহন চলাচলের পাশাপাশি শুরু হয় ভারী যানবাহন চলাচল। ২০ টন থেকে ৩০ টন পাথর বোঝাই কভার্ডভ্যান চলাচল করায় ব্রীজে ফাটল দেখা দেয়। ঘুমিয়ে থাকা কর্তৃপক্ষের ঘুম ভেঙে যায়। ফাটল নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখির শুরু হয়। বাধ্য হয়েই ব্রীজের ওপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে বেহাল অবস্থায় ডালিয়া সুইচ গেইট ও আশপাশের রাস্তা। এলাকার সাধারণ মানুষ জানান, তিস্তা সেচ প্রকল্প হলো বাংলাদেশের দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। দুঃখজনক হলো কর্মকর্তাদের খামখেয়ালী এবং প্রতিমন্ত্রী পুত্রের ‘খাই খাই’ মেটাতে গিয়ে ব্রীজটি দৈন্যদশায় পড়ে গেছে।
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় ধানের আবাদ চমৎকার। করিডোরের দুই পার্শ্বে ভারতীয় জমির ধান আর আমাদের দেশের ধানি জমির একই দৃশ্য। পাটগ্রামের বাবুল-কামাল গ্রামে (কাঁটা তাদের বেড়া সংলগ্ন) কৃষকরা জানান, ভারত বাংলাদেশের সর্বনাশ করলেও সীমান্তে এই ধানের ফলনের ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ভারতের সীমান্তে বিদ্যুতের যে সব হাজার হাজার পাওয়ারী বাতি জ্বালানো হয় সন্ধ্যার আগে, সেগুলো সীমান্তের কৃষির জন্য ‘সাপেবর’ হয়েছে। বাতিগুলো জ্বালানোর পর প্রয় আধামাইল থেকে এক মাইল দূরত্বের ক্ষেত থেকে বিভিন্ন পোকামাকড় পঙ্গপালের মতো ছুটে যায় ওই বাতির দিকে। সেখানে সেগুলো মারা যাওয়ায় সীমান্তের জমিতে ধানগাছে কোনো পোকামাকড়ের আক্রমণ স্থায়ী হয় না। লালমানির হাটের হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, মোগলহাট সীমান্তের কৃষকরা একই কথা জানান। কুড়িগ্রামের গংগার হাট (দাশিয়ার ছড়া সাবেক সিটমহলের পাশে) ও থেকে ফুলবাড়ি সীমান্তে বিভিন্ন এলাকায় ক্ষেতের সবুজের সমারোহ দেখে জানাতে চাইলে কৃষকরা একই তথ্য দেন। তাদের মতে ভারত হাজার পাওয়ারী বাতি দিয়ে আমাদের কৃষির উপকারই করেছে।
এবারের বন্যায় রংপুর বিভাগের হাজার হাজার গ্রাম তলিয়ে যায়। বন্যার কবলে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। অনেকের জমির ফসল নষ্ট হয়। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকা নিলফামারীর ডোমার, ডিমলা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, আদিতমারী, রংপুরের গংগাছড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, কুড়িগ্রামের তিস্তা, ধরলা ও ব্রক্ষপুত্র নদী অববাহিকা উলিপুর, কুড়িগ্রাম সদর, জামালপুরের মাদারগঞ্জ, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধনুট, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, সদর, চৌহালির বিশাল এলাকায় বন্যা পলি ফেলে যায়। ওইসব জমিতে পলি পড়ায় মাটির উর্বরা শক্তি বেড়ে গেছে। এতে ধানের ফলন ভাল হয়। রৌমারীর ব্রক্ষপুত্র নদের পাশের অষ্টমীর চর, বড় চর, মাঝের চর, ফেইসকার চর, কোদালকাঠি চর, কর্তিমারীর চর, সানন্দবাড়ি চর ও চিলমারীর চরে ধানের ফলন খুব ভাল। যব, কলাইও বেশ চমৎকার। চরের কৃষরা জানালেন, বাদাম ও ভুট্টার ফলন অতিতের যে কোনো বারের তুলনায় এবার ভাল হয়েছে বন্যা পলি ফেলে যাওয়ায়। নদী ভাঙনে কিছু ধানি জমি নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে; এতে কিছু কৃষক সর্বস্ব হারাচ্ছে। কিন্তু ফসল ভাল হওয়ায় চরুয়ারা (চরের মানুষ) দারুণ খুশি। চিলমারীর চরের সুবল দাস নামের এক কৃষক জানান, তার দুই বিঘা জমি নদীতে গেলেও বাকী ৬ বিঘায় যে ধান হবে তা তাতেই তার চলে যাবে। তিনি জানান, বন্যার ফেলে যাওয়া পলি আর যথা সময়ে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হওয়ায় ফসল ভাল। কাউনিয়া ব্রীজের নীচে দাঁড়িয়ে কথা হয় সরোয়ার আলীর সঙ্গে, পেশায় কৃষক হলেও বছরের অর্ধেক সময় মাছ ধরেন। জানালেন, এবার ক্ষেতে যে ধানের লকলকে গাছ দেখা যাচ্ছে তাতে প্রচুর ধান পাবেন। ধান বিক্রী করে মেয়ের বিয়ে দেবেন সে স্বপ্ন মনে মনে বুনছেন। গংগাছড়ার একাধিক কৃষককের মতে এবার যে ভাবে ধানের ফলন দেখা যাচ্ছে তাতে এবার যদি কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তাহলে তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে আগামী আউস মৌসুমে ইরি ধানের চাষ করবে। ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় নিলফামারী ও রংপুরের অনেক কৃষক বাধ্য হয়েই তামাকের চাষ করেন বলে তিনি জানান। চিলমারী থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ব্রক্ষপুত্র পাড়ি দিয়ে রৌমারী যেতে দুই ঘন্টার পথ। মাঝ নদীতে যেতেই মনে পড়ে গেল দহগ্রাম আঙ্গরপোতার সর্দারপাড়ার কৃষক জাকির হোসেনের কথা। দু’দিন আগে জাকির সবুজ ধানের ক্ষেত দেখিয়ে বলেছিলেন, স্যার প্রকৃতি আমাদের দিকে তাকিয়েছে; বন্যার পলি ও যথা সময়ে বৃষ্টি হওয়ায় ধানের ফলন ভাল হয়েছে। সরকার যদি ধানের ন্যার্য্য মূল্য নিশ্চিত করে তাহলে ১৬ কোটি মানুষ খেয়েদেয়েও আমাদের উৎপাদিক ধান বিশ্বের দেশে দেশে রফতানি করা সম্ভব হবে। ৩০ বছর ধরে কৃষিকাজ করি। এবারের মতো ধানের হৃষ্টপুষ্ট গাছ কোনো বছর দেখিনি। ততক্ষণে মনের অজান্তে গাইতে শুরু করছি ‘ধানে ধন্যে পুষ্টে ভরা/ আমাদের এই বসুন্ধরা’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন