দীর্ঘ দু'যুগ ধরে খরস্রোতা মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর এবং রামগতি উপজেলা দু'টোর আয়তন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। দু'উপজেলার লক্ষাধিক নিরীহ জনগণ হারিয়েছে তাদের ভিটেমাটি পৈতৃক নিবাস,হারিয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য। নদী ভাঙ্গনের ফলে নিঃস্ব হয়ে হাজার হাজার পরিবার সড়কের দু'ধারে খোলা আকাশের নিচে নিদারুণ ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছে। একদশক ধরে দু'উপজেলার ৭লক্ষাধিক জনগণ নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার দাবিতে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা মানববন্ধন সভা সেমিনার ও আন্দোলনের ফলে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মানবিক এ দাবিটি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে তিনি একনেক সভায় নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনুমোদনসহ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রথম টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে।
এতে প্রথম অবস্থায় ৩ কিলো ৪শ মিটার কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষের পর আগামী ১ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। চলতি মাসের মধ্যে আরো দরপত্র প্রকাশ হবে বলে জানিয়েছেন, লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ফারুক আহমেদ। তবে প্রথম থেকেই এ কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে চায় এলাকাবাসী।সেনাবাহিনীর তত্বাবধায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব:)আবদুল মান্নান ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত আবেদন ও করে থাকেন।
গত ১৭ আগস্ট ই-জিপি টেন্ডার পোর্টাল এবং বুধবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ৪টি প্যাকেজ এবং ১১ লটে বিভক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে মোট ৩৪শ মিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে রামগতি এবং কমলনগরে। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।
মেঘনা নদীর “বড়খেরী, লুধুয়াবাজার এবং কাদিরপন্ডিতেরহাট বাজার’ তীররক্ষা নামের ৩৩.২৬কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটি ( Project Code 224337900 ) গত ৩ জুন তারিখে পাশ করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক । এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার কোটি টাকা ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
প্রকাশিত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ১১টি লটের (Lak/W-10/Lot-01/2021-2022) মধ্যে ১ম লটে ২৭৫ মিটার, ২য় লটে ২৭৫ মিটার, ৩য় লটে ৩৫০ মিটার, ৪র্থ লটে ৩৫০ মিটার, ৫ম-১০ম লটের প্রতিটিতে ৩০০ মিটার এবং ১১তম লটে ৩৫০ মিটার সহ মোট ৩ হাজার ৪০০ মিটার কাজ হবে।
এদিকে এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নদী বাঁধ নির্মাণ আন্দোলনের সাথে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি টেন্ডার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আন্দোলনের তীব্র ডাক দেয়।এবং অচিরেই যথাযথ নিয়মে সেনাবাহিনীর অধীনে নির্মাণকাজ শুরুর আহবান জানান।
স্থানীয়দের দাবী মেঘনা নদী ভয়াবহ ভাঙ্গনে থেকে লক্ষ্মীপুরে রামগতি এবং কমলনগর উপজেলা কে রক্ষার জন্য একমাত্র আস্থারস্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দিয়ে এ কাজ করানো। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর পরপরই জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে কাজ হয়তো সেনাবাহিনী দিয়ে করা হবে না বলে ধারনা করা হচ্ছে। আর সেনাবাহিনী দিয়ে কাজ বাঁধ নির্মাণ কাজ না করা হলে আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়া হবে বলে ও জানান স্থানীয় জনসাধারণ।
কমলনগর নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটির আহবায়ক ও প্রেসক্লাব সভাপতি এম এ মজিদ'র দাবী,যদি সেনাবাহিনী দিয়ে কাজ না করা হয়, তবে দুর্নীতির আশংকা থাকবে ব্যাপক।তিনি দাবী করেন সেনাবাহিনীর কাজ এবং ঠিকাদারের কাজ মিলে ২ ধরনের কাজের প্রমাণই রামগতি এবং কমলনগরে আছে। সেনাবাহিনীর কাজের মান বিশ্বমানের। আর ঠিকাদারের মাধ্যমে শেষ হওয়া কমলনগরের মাতাব্বরহাট বেড়ীবাঁধ এখন অনেকটা হুমকির মুখে।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের মধ্যে আরো রয়েছেন, কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চের আহবায়ক এডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ শামসুল আলম, নদী বাঁধ আন্দোলনকারী এডভোকেট রিপন পাটোয়ারী,কমলনগর প্রেসক্লাব উপদেষ্টা মিজানূর রহমান মানিক,সাজ্জাদুর রহমান,প্রভাষক বেলাল হোসেন জুয়েল, সাংবাদিক কাজী মুহাম্মদ ইউনুছ, প্রেসক্লাব সম্পাদক ইউছুফ আলী মিঠু, চর লরেঞ্চ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ হিরন, সাহেবের হাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, চর কালকিনি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাষ্টার সাইফুল্লাহ, পাটারির হাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুরুল আমিন রাজু । তাঁদের অভিমত দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি গোচর করাতে পেরেছি। এতে করে সরকার নদীর তীর সংরক্ষণের নিমিত্তে অর্থ বরাদ্দসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেখলে ও কোন কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদাররা কাজ পেলে জলের অর্থ জলেই মিশে যাবে বলে আশঙ্কা করেন তারা।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাষ্টার নুরুল আমিন জানান, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ কাজ করা হলে অনিয়ম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেনা তাছাড়া কাজের মান টেকসই হবে বলে মনে করি।
এদিকে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ফারুক আহমেদ জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে ৩ হাজার ৪শ মিটার কাজের টেন্ডার হয়েছে। চলতি মাসে আরো হবে। এর মধ্যে বাঁধ ছাড়াও ২০টি স্লুইস গেটও তৈরি করা হবে। জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র (এনটিসি) এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি(ওটিএম) এর মাধ্যমে দরপত্রগুলো আহবান করা হয়েছে।
অনতিবিলম্বে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ৭ লক্ষ ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীর একমাত্র দাবির প্রতি নূন্যতম সম্মান ও একাত্বতা সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কমলনগর -রামগতির মেঘনার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এ অঞ্চলের সর্বস্তরের জনগণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন