হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীর জানাজা-দাফনে লাখো তৌহিদি জনতা : সর্বস্তরে শোকের ছায়া
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ আলেম আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাসচিব শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী আর নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিদায় অকুতোভয় মজলুম আলেমেদ্বীন।
তিনি বেলা ১১টায় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ৬৮ বছর বয়সী এই মজলুম আলেমকে অ্যাম্বুলেন্সে হাটহাজারী থেকে নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনী, ডায়বেটিকস, হাই-প্রেসারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সকাল ১০টায় হঠাৎ তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর হাসপাতালে নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পাঁচ কন্যা, এক পুত্র সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেনে।
ঈমানী তেজদীপ্ত অকুতোভয় প্রখ্যাত এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালের খবরে চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের আলেম-উলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ তৌহিদি জনতা হাসপাতাল এবং হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে আসেন। তাকে শেষ বিদায় জানাতে হেফাজতের নেতাকর্মী, সমর্থকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাটহাজারী মাদরাসায় আসেন। তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা এবং জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগরে নেমে আসে শোকের ছায়া। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতাল থেকে তাকে হাটহাজারী মাদরাসায় নেয়া হলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। চট্টগ্রাম নগরী থেকে হাটহাজারী মাদরাসা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে শোকার্ত মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান।
প্রবীণ এ শিক্ষকের আকস্মিক ইন্তেকালের খবরে ছুটে আসা হেফাজতের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, আলেম-উলামা, মাদরাসার শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সুশৃঙ্খলভাবে জানাজা দাফন সম্পন্ন করতে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসায় দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হন হেফাজত নেতা ও মাদরাসার শিক্ষকগণ। প্রথমে বাদ মাগরিব হাটহাজারী মাদরাসায় তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হলেও পরে সারাদেশের আলেম-উলামাদের অনুরোধে সময় বাড়িয়ে রাত ১১টায় করা হয়। হাটহাজারী মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা ইয়াহিয়া জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে জানাজায় শরিক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে রওনা দেন। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে হাটহাজারী মাদরাসা ময়দানে বিশাল নামাজে জানাজা শেষে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। হাটহাজারী মাদরাসা প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় লাখো তৌহিদি জনতা অংশগ্রহণে বিশাল এ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক এবং তৌহিদি জনতার প্রাণপ্রিয় ঈমানী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির ও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন তিনি। দেশে ইসলামী ভাবধারা, ঈমান-আকিদা সংরক্ষণ এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করেছেন মজলুম এ আলেম। নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের আপোসহীন ভ‚মিকার কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী। ঈমান আকিদা রক্ষায় হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতে ঐতিহাসিক লং মার্চ এবং পরবর্তিতে শাপলা চত্বরে ট্র্যাজেডিতে তিনি সাহসী ভুমিকা পালন করেন। ক্ষমতাসীন মহলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারে বারে লোভ-প্রলোভন, হুমকি-ধমকি দেয়া সত্তে¡ও তিনি তার নিরপেক্ষ অবস্থানে অটল থাকেন। সকল ভ্রুক‚টি উপেক্ষা করে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘আমরা কোন দলের বিরুদ্ধে নই, সুতরাং আওয়ামী লীগেরও বিরুদ্ধে নই। আবার আমরা কোন দলের পক্ষেও নই।’ ঈমান আকিদার প্রশ্নে তিনি ছিলেন লড়াকু এক মর্দে মোজাহিদ। এই কারণে তাকে অনেক জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
হেফাজত নেতারা জানান, শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডির পর তাকে গ্রেফতার করে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়। সে সময় টানা নির্যাতনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিনা চিকিৎসায় দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হননি। অসুস্থতা নিয়েই ঈমান আকিদা রক্ষার সংগ্রামে ছিলেন লড়াকু ভ‚মিকায়। স¤প্রতি দেশব্যাপী গ্রেফতারকৃত হেফাজত নেতাসহ দেশের আলেম-উলামাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে সাক্ষাত করেন তিনি। ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেও আলেম-উলামাদের পক্ষে অবস্থান নেন বাবুনগরী।
সর্বশেষ গত ১৭ আগস্ট কওমি মাদরাসাসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন তিনি। বিবৃতিতে তিনি দেশের সবকিছু উন্মুক্ত রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কোনই যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। উলামায়ে কেরামের আহবান সাড়া দিয়ে সরকার গত বছরের আগস্ট মাস থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কওমি মাদরাসাসমূহের শিক্ষাকার্যক্রম চালুর অনুমতিদানের কথা উল্লেখ করে তাতে বলা হয়, এই ৮ মাস সময়ে কোন মাদরাসায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার নজির ছিল না। কওমি মাদরাসাসম‚হের এই ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে শুধু মাদরাসা নয়, বরং কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ রাখা বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে বিবৃতিতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর সিদ্ধান্ত দিতে সরকারের প্রতি আহবানও জানিয়েছিলেন তিনি।
১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাবুনগরীর জন্ম হয়। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি জমিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা শেষে তিনি আরবি ভাষায় সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। সেখান থেকে তিনি হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি এ মাদরাসার শায়খুল হাদিস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
অপরদিকে ২০১৩ সালে তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের পর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বরের হেফাজত আমির পদে মনোনীত হন। এরপর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নানা কারণে ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গত ৭ জুন ৩৩ জনে উন্নীত হয়। ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনে অর্ধ শতাধিক মামলার আসামি হন প্রবীণ এ আলেমেদ্বীন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে বিক্ষোভের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে হাটহাজারী থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ।
মামলা লড়েছেন আমৃত্যু
হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী আমৃত্যু মামলায় লড়ে গেছেন। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে হাটহাজারীতে পুলিশের গুলিতে চার হেফাজত কর্মী নিহতের ঘটনায় সহিংসতার দুটি মামলায় জুনাইদ বাবুনগরীকে আসামি করা হয়।
হাটহাজারীর দুটি মামলায় আসামি ছিলেন তিনি। এর আগে শাপলা চত্বরের ঘটনায় মারধর, লুটতরাজ ও হত্যার অভিযোগ এনে মতিঝিল থানায়ও মামলা হয়েছিল বাবুনগরীর বিরুদ্ধে। সে মামলায় তাকে গ্রেফতার করে টানা রিমান্ডে নেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি জামিন পান। চলতি বছরের মার্চের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত ফের সচল করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও পুনঃতদন্ত চলছে বলে জানান হেফাজত নেতারা। মামলা হুলিয়ার পরও দৃঢ়চেতা ও সাহসী মজলুম এ নেতা ছিলেন ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনের অকুতোভয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন