শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৩ এএম

করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এর কয়েক দিন পর ২৬ মার্চ থেকে অফিস আদালতে সাধারণ ছুটি, যানবাহন চলাচল ও দোকান পাঠ বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন শুরু হয়। লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ২০২০ মাসের জুনের শুরু থেকেই সরকার জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্যান্য দেশের মতো লকডাউন শিথিল করে। ফলে সবকিছুই আস্তে আস্তে খুলে যায়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় চালু হয় এবং জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। পরবর্তীতে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় বেড়ে যাওয়ায় ২০২১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি হতে সরকার আবার লকডাউন ঘোষণা করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে এ লকডাউন মাঝে মাঝে স্থগিত হয়েছে এবং মাঝে মাঝে আবার বহাল হয়েছে। এভাবে সর্বশেষ ১০ আগস্ট পর্যন্ত এ লকডাউন বিদ্যমান ছিল। তবে জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে ১১ আগস্ট থেকে সরকার লকডাউন স্থগিত করেছে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সবকিছু খুলে দিয়েছে। আর ১৯ আগস্ট থেকে পর্যটনকেন্দ্রসমূহও খুলে দিয়েছে। ফলে সবকিছুই আবার আগের মতো খুলে গিয়েছে এবং সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় পুরোদমে শুরু হয়েছে। আসলে লকডাউন তুলে নিয়ে সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু রাখার কোন বিকল্পও ছিল না।

করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে ১৭ মার্চ ২০২০ সাল হতে এ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ১৭ মাস যাবত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটানা বন্ধ রয়েছে। এ সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখে শিক্ষার ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে পিএসসি, জেএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি এবং এসাইনমেন্টের মাধ্যমে অটোপাশ দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে যারা এইচএসসি পাশ করেছে স্নাতক পর্যায়ে তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। শুধুমাত্র মেডিকেলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগর, কৃষি, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, নোয়াখালী, জগন্নাথসহ সরকারি বিশ^বিদ্যালয়সমূহে ভর্তি প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। এমনকি জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়েও ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। ২০২১ সালের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা ও এখনো সম্পন্ন হয়নি। শিক্ষা জীবনের শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত না হবার কারণে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষামূলকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিৎ। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিদ্যমান ছুটি আর না বাড়িয়ে ১ সেপ্টেম্বর হতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। কারণ, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। করোনাভাইরাসের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে এবং তা করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো আর বন্ধ থাকতে পারে না। আজ হোক, কাল হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্তু খুলতেই হবে। যেহেতু করোনার প্রকোপ কমে এসেছে, করোনার টিকাও আবিষ্কার হয়েছে এবং জনগণ ব্যাপক হারে টিকা গ্রহণ করছে, তাই শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কারণে যদি সংক্রমণ বৃদ্ধি পায় তাহলে প্রয়োজনে পুনরায় বন্ধ করে দেয়া যাবে এবং সেই সুযোগ তো আমাদের হাতেই রয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলেছেন। সেগুলো হচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক পরিধান করা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। কোন অবস্থাতেই জনসমাগম করা যাবে না এবং যত সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত গবেষণা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছেন এবং সেই টিকার প্রয়োগও ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে দেশে অনেক মানুষ টিকা গ্রহণ করেছে এবং লোকদের টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। জনগণ ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে টিকা গ্রহণ করছে এবং আশা করা যাচ্ছে আগামী এক বছরের মধ্যেই বিশ্বের সকল মানুষকে টিকা প্রদান সম্ভব হবে। এতদসত্তে¡ও বিজ্ঞানীরা বলেছেন, করোনাভাইরাস অনেক বছর ধরে বিদ্যমান থাকার আশঙ্কা রয়েছে এবং করোনাভাইরাস থেকে মানবজাতির সহসা মুক্তির সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় করোনা পরিস্থিতিকে একটি সমস্যা হিসাবেই মানতে হবে এবং এই সমস্যার মাঝ দিয়েই সামনের দিকে পথ চলতে হবে।

অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত আছে বটে, তবে এটা বিদ্যমান শিক্ষা পদ্ধতির বিকল্প নয়। এটি হচ্ছে সহায়ক এবং সাময়িক সমাধান মাত্র। শিক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন থেকে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া থেকে কিছুটা হলেও দূরে আছে। ফলে তারা অন্য কিছুতে মনোযোগী হয়ে পড়ছে এবং এটা তাদের শিক্ষাজীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় অতি দ্রুত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিকল্প নেই। যেহেতু করোনাভাইরাস পুরোপুরি নির্মূল হয়নি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া দরকার, তাই শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই পরিবর্তন হতে হবে সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। এ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকার করোনা টিকা গ্রহণের বয়স সীমা ১৮ বছর নির্ধারণ করেছে। সুতরাং প্রাথমিক এবং হাইস্কুল লেভেলের শিক্ষার্থীদের আপাতত টিকা দেয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ এদের সবারই বয়স ১৮ বছরের কম। সুতরাং প্রাইমারি এবং হাই স্কুল লেভেলের সকল শিক্ষক কর্মচারীকে অতিদ্রুত টিকা দেয়া হোক এবং প্রাইমারী ও হাইস্কুল লেভেলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। আর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও একই সাথে খুলে দেয়া হোক এবং এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদেরকে টিকা দেয়া জোরদার করা হোক। অর্থাৎ টিকাও চলবে, শিক্ষাও চলবে।

কোন অবস্থাতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি আর বাড়ানো ঠিক হবে না। বিশ^বিদ্যালয়সমূহে সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়াটা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কারণ, ২০২০ সালের এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। আর ২০২১ সালের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা সরকার ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন করতে হবে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ক্লাসরুমসহ বিভিন্ন কক্ষে অনেক ময়লা জমেছে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনা, বিভিন্ন কক্ষ এবং বাথরুম আগে ভালো করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে এর পরেই তা ব্যবহারের জন্য খুলে দিতে হবে। ছাত্র শিক্ষক সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে আসবে এবং ক্লাস শেষ করেই বাসায় চলে যাবে। ছাত্রছাত্রীরা দূরত্ব বজায় রেখেই ক্লাসে বসবে এবং কোন রকম জমায়েত করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীরা তাদের সুবিধামত ক্লাসে উপস্থিত থাকবে, তবে যথাসময়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। পরীক্ষার সময় হবে এক ঘণ্টা এবং সেটার প্রশ্ন হবে এমসিকিউ। আগে যেখানে পরীক্ষা হতো তিন ঘণ্টা, সেখানে এখন পরীক্ষা হবে এক ঘণ্টা। ফলে এক দিনে কয়েক শিফটে পরীক্ষা নেয়া যাবে এবং এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিড় কম হবে। কোন ছাত্রছাত্রী অসুস্থতার কারণে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হতে না পারলে তার পরীক্ষা বাসায় নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। করোনার প্রভাব পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। মোট কথা, করোনাকালে শিক্ষা এবং পরীক্ষা একটু সহজ করতে হবে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর যদি করোনার সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায় তাহলে প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবারো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন