শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আমাদের কাছে নজরুল আর কত অবজ্ঞাত থাকবেন?

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৪ এএম

আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে আশানুরূপ নজরুল সাহিত্য যে পড়ানো হয় না সেদিকে নজর দেওয়ার সময় কি আমাদের হয়েছে? প্রভাত মুখোপাধ্যায় সাত খন্ডের ‘রবীন্দ্র জীবনী’র পরও প্রশান্ত পালের ‘রবীন্দ্র জীবনী’ মৈত্রেয়ীদেবীসহ আরো বহু বিশেষজ্ঞরা যেভাবে রবীন্দ্র জীবনীর পুঙ্খানুপুঙ্খ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, তেমনভাবে কি নজরুল জীবনী রচিত হবে? নজরুল ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন নিয়ে এ পর্যন্ত একটি গ্রন্থও তো রচিত হলো না। আজও কবির লেটোর দলের জীবন এবং করাচীর পল্টন জীবন আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেল। নজরুলের চলচ্চিত্র, নজরুলের গ্রামোফোন, নজরুলের সাংবাদিকতা, নজরুলের রাজনীতি, নজরুলের সাহিত্য, কবিতা, গান ও তাঁর জীবন দর্শন নিয়ে বড় কোনো গবেষণামূলক কাজ কি হয়েছে বিগত একশ বছরে? তাহলে আমরা পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে জানবো কী করে বা কীভাবে নজরুলকে তুলে ধরব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে? হিমালয়সম এ বিশাল মানুষটিকে স্পর্শ করবো কী করে, যদি না তাঁর ধারে কাছে পৌঁছাতে পারি। তাহলে কি নজরুলকে ধারণ করার মতো আত্মার ব্যাপ্তি বাঙালি মুসলমানদের নেই। সেদিন এক বিদেশি বলল, তোমাদের জাতীয় কবির কিছু সৃষ্টিকর্ম আমি দেশে নিয়ে যেতে চাই। বললাম, সরি! কবির তেমন কোনো অনুবাদ কর্ম এ পর্যন্ত এদেশে হয়নি। বিদেশি অবাক হলেন। অবাক হবারই কথা। আমরাও অবাক হই। এত বছরেও নজরুলের অনুবাদ গ্রন্থ নেই। বাঙালি মুসলমানের নিবিড় তমসা আচ্ছন্ন যুগে আলোর মশাল হাতে যিনি মৃতপ্রায় বাঙালি মুসলমানকে নব যৌবন মন্ত্রে উদ্দীপিত করলেন, জাতীয় চেতনার উৎসরণে যে কবি নবীন তূর্যবাদকের ভূমিকা পালন করলেন, যাকে ঘিরে একটি মৃতপ্রায় জাতির নবজাগরণের সূচনা হলো, তাঁকে আমরা মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হলাম কীভাবে? তাঁর জন্য কি কিছুই করার নেই আমাদের?

আমার মনে পড়ে, শুনেছিলাম সরকারি উদ্যোগে নজরুল জন্ম শতবার্ষিকী উৎসব পালিত হবে জোরেসোরে। আরও শুনেছিলাম একশ ছেলেমেয়ে মিলে গান গাইবে, একশ ছেলেমেয়ে মিলে আবৃত্তি করবে, আরও হয়তো অনেক কিছইু হবে। প্রাধানমন্ত্রী হয়তো বেলুন উড়িয়ে হাজারো করতালির মধ্যে উৎসব উদ্বোধন করবেন এমনটা এর আগে আর হয়নি বলে বাহবা নেবেন, যা সচরাচর হতে দেখা যায়। কিন্তু নজরুলের মাজারটি অন্ধকারে অবহেলিতই পড়ে থাকবে। নজরুল ভক্তদের বহু দিনের সাধ মাজার প্রাঙ্গনে সুউচ্চ স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠুক, জেলায় জেলায় নজরুল ভবন, পাঠাগার গড়ে উঠুক, একটা সমৃদ্ধ নজরুল জাদুঘর গড়ে উঠুক। সেগুলোর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের মতো দীর্ঘস্থায়ী গঠনমূলক কাজে কেউ এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। আসলে আমরা নজরুলকে ব্যবসার সওদা হিসেবে নিয়েছি, ভালবাসা দিয়ে নজরুলকে আপন করে নিতে পারিনি। সাজসজ্জা ঠিক আছে, হৃদয়ে নজরুলভক্তি নেই। এর মূল কারণ হয়তো জাতিগতভাবে আমাদের অজ্ঞতা। এদেশে নজরুল চেয়ার আছে, নজরুল অধ্যাপক আছে- অথচ নজরুল পড়ানো হয় না, এমন ট্রাজেডি বোধহয় বিশ্বের কোথাও নেই। এখানে নজরুল কাব্য সম্ভারের গভীরে যাওয়ার প্রচেষ্টা নেই, মুখে মুখে কেউ নিন্দা করছেন কেউ প্রশংসা করছেন। কেউ বা অগ্নিবীণার প্রথম কবিতা পাঠ করেই নজরুল সম্পর্কে ধারণা নিয়ে উল্লসিত হচ্ছেন অথবা নিন্দা বর্ষণ করছেন। আসলে নজরুল কে ছিলেন, কী ছিলেন, সেটুকু জানার ক্ষেত্রেও আমরা বহুদূরে পড়ে আছি। জানার চেষ্টাও করছি না।

মহাকাব্য না লিখেও নজরুল ছিলেন মহাকবি। কারণ, মহাকাব্য রচয়িতাগণ যেমন জীবনের সকল দিকে অর্থাৎ মানব মনে যে সব প্রশ্ন সততই উত্থিত হয় তার সব দিকে আলোকপাত করে থাকেন, নজরুলও তেমনি তাঁর খন্ড কাব্য এবং দীর্ঘ কবিতায় জীবনের সকল দিকে আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছেন, সেজন্যই তিনি হাফিজ, ইকবালের মতো মহাকবি। নজরুল বিদ্রোহী, নজরুল প্রেমিক, নজরুল মানবতাবাদী, নজরুল শ্রেণীসংগ্রামী, নজরুল মরমী, নজরুল সাধক, সবার উপরে নজরুল মুসলমান। এতগুলো পরিচয়ের একটা বৃত্তকে অবলস্বন করে তাঁর সৃষ্টির বিচার করলে সম্পূর্ণ নজরুলকে পাওয়া যাবে কি? আবার নজরুল সাহিত্যের বহুমুখী সৃষ্টির বিষয়টুকুই যদি আলোচনা করা হয়, তাহলেও পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে পাওয়া যাবে না। পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে পেতে হলে কবি মানসের অন্তঃস্থিত গূঢ় সত্তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। তাঁর মর্মমূলে যে ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল, তারই আলোকে কবির সৃষ্টিকে বিচার না করলে, কবির বহিরাবরণটুকুই দৃষ্টিগোচর হবে, তাঁর অন্তরের সন্ধান পাওয়া যাবে না। যারা নজরুলকে খন্ডিত করে দেখতে চান তারা কবির বহিরাবরণটুকুই দেখেন, অন্তরের খবর নেন না।

নজরুল ইসলামের অনন্য সৃষ্টির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদেরই কবি, এ বিষয়ে কোনো ভ্রান্তি থাকার অবকাশ নেই। তবে ইসলাম ধর্মের ঔদার্য নিয়ে তিনি সকল ধর্মের সহাবস্থানেও ছিলেন। আর্য, অনার্য, শক, হুন, পাঠান, মোগলকে এক দেহে লীন করতে চাননি। তিনি বিধর্মীদের ঘৃণা করতেন না, তাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়েও রাখতেন না।

নজরুলের যখন আবির্ভাব তখন বাংলার মুসলমানদের ঘোরতর দুর্দিন। পলাশীর অব্যবহিত পরেই হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগিতায় শিক্ষা-দীক্ষায়, আচার, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেন। মুসলমানরা পড়ে রইল সংকীর্ণ ডোবার পানিতে আবদ্ধ হয়ে। নিরাশ, নিষ্ক্রিয়তা, বিমূঢ়তায়, বাংলার মুসলমানরা যখন মৃতপ্রায়, তাদের জীবনের আলো, আশা, উদ্দীপনা, কর্মপ্রেরণা, চাঞ্চল্য যখন লুপ্ত প্রায়, তাদের সামনে-পিছনে, ডাইনে-বামে যখন শুধুই হতাশার অন্ধকার, ঠিক সে সময় ধুমকেতুর মশাল হাতে নজরুলের আবির্ভাব। তিনিই প্রথম বুঝলেন, এ মৃতপ্রায় জাতিকে জাগাতে হলে তাদের যৌবনমন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। তাদের মধ্যে মানবতার অহংবোধ জাগাতে হবে। তাই চির যৌবনা বিদ্রোহী মূর্তি ধারণ করে বললেন:

‘বল বীর চির উন্নত মম শির।’
নজরুল ইসলামের কাব্যে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নাটকে মুসলিম ঐতিহ্যবোধের চেতনা সুস্পষ্ট। ঐতিহ্যবোধ থেকেই আসে স্বদেশপ্রেম আর স্বদেশপ্রেমই পরাধীনতার বন্ধন মুক্তির উদগ্র বাসনা জাগায়।মুসলিম ঐতিহ্যবোধ থেকেই তিনি বন্ধন মুক্তির গান গেয়েছেন:
‘কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর।’

কবিকে ধর্মনিরপেক্ষতার দলে যতই টানতে চাই না কেন, তিনি নিজ ধর্ম, ঐতিহ্য, চেতনা থেকে এক চুলও সরে যাননি। তাহলে তিনি লিখতেন না:
‘শাতিল আরব! শাতিল আরব! পূত যুগে যুগে তোমার তীর,
শহীদের লহু, দিলীদের খুন ঢেলেছে সেখানে আরব বীর।’
তিনি লিখতেন না:
‘জুলফিকার আর হায়দরী হাঁক
হেথা আজও হযরত আলীর
শাতিল আরব! শাতিল আরব!
জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।’
তিনি মুসলিম ঐতিহ্যের কবি না হলে তাঁর কলম থেকে বেরুত না:
‘আবু বকর, উসমান, ওমর আলী, হায়দার
দাঁড়ি যে এ তরীর, নাই ওরে নাই ডর
কান্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি-মাল্লা
দাঁড়ি মুখে সারিগান লা শরিক আল্লা।’

তিনি ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন বলেই ৩০০-এর ওপর ইসলামী গান রচনা করতে পেরেছিলেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ১৯৪১ সালে ঈদের নাটক প্রচার করতে পেরেছিলেন, স্বকণ্ঠে রেডিওতে ক্বোরআন তেলাওয়াত ও আজান প্রচার করতে পেরেছিলেন, ঈদের গান রচনা করেছিলেন, যা তাঁর সমসাময়িক কোনো কবি করেননি। ইসলামের দুই স্তম্ভ তৌহিদবাদ ও জেহাদ নজরুলের লেখাতেই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন