শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পাক-ভারত উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ

প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দু’ সপ্তাহের বেশী সময় ধরে চলমান পাক-ভারত উত্তেজনা অবশেষে প্রশমিত হতে চলেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উরি সেনা চৌকিতে জঙ্গি হামলায় অন্তত ১৮ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারো যুদ্ধাবস্থা তৈরী হয়। ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে সামরিক হামলার হুমকি এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সমুচিত জবাব দেয়ার ঘোষণায় দুই দেশের সীমান্তে তীব্র উত্তেজনা, সমরসজ্জা এবং সীমান্ত সংঘাত শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে যে কোন সময় বড় ধরনের সামরিক সংঘাত শুরুর আশঙ্কা দেখা দেয়ায় বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশিত হয়। আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানান হয়। তবে আজাদ কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দাবীকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলেও অবশেষে দুই পক্ষই আলোচনা ও সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়েছে। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং নাসির জানজুয়ার মধ্যে প্রথম টেলিফোন সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে ফোনালাপ ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের ফোনালাপের কথা স্বীকার করেছেন এবং তারা উভয়েই সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে সম্মত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ইতিপূর্বে গত রোববার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট নিরসনের আভাস দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও দারিদ্র্যপীড়িত দক্ষিণ এশিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান গত সাত দশকে অন্তত চারবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে দুই দেশই পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে। এ অঞ্চলে ভারত-পাকিস্তান ছাড়াও চীন-ভারতের মধ্যেও সামরিক প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে সামরিক হামলার ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার পরই চীন পাকিস্তানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। একইভাবে ইরান-সউদী আরবের মত আঞ্চলিক শক্তিও পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করে ফেলার যে প্রত্যয় ভারতের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল গত দুই সপ্তাহে দুই দেশের উত্তেজনা ও ধারাবাহিক ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে তা’ও ব্যর্থ হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। কারণ, ভারতের সাথে দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও তীব্র উত্তেজনা ও যুদ্ধাবস্থায়ও রাশিয়ান বিমান বাহিনী পাকিস্তানে এসে প্রথমবারের মত যৌথ সামরিক মহড়ায় যোগ দিয়েছে। যদিও একটি সামরিক মহড়াই সম্পর্কের সবকিছু পাল্টে দেয়না, তথাপি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থায় ও পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলার হুমকির মধ্যে এই বাস্তবতা ভিন্ন বার্তা বহন করে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিশাল ভারতের সাথে সামরিক শক্তি-সামর্থ্যে পাকিস্তানের যত ঘাটতিই থাকুক, মাঠের বাস্তবতায় দুই পক্ষে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরী হয়েছে এবং এই ভারসাম্য অবস্থার কারণেই দুই পক্ষ নিজেদের উদ্যোগে উত্তেজনা প্রশমনে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এটি একটি ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক ঘটনা। ক্ষুধা-দারিদ্র্যপীড়িত দু’টি উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনে যুদ্ধ কোন সমাধান হতে পারেনা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অতীতে কোন সুফল দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবেনা। দুই পক্ষের মধ্যে ফোনালাপ তাদের শুভবুদ্ধির পরিচায়ক। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা ও যুদ্ধাবস্থায়ও একটি বেসরকারী সংস্থার আয়োজনে ভারতের চন্ডিগড়ে অনুষ্ঠিত ১১তম গ্লোবাল ইয়ুথ পিস ফেস্টিভালে ভালবাসার বার্তা নিয়ে যোগ দিয়েছেন ১৯ পাকিস্তানি তরুণী। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদে তারুণ্যে সেই বিশ্বশান্তির উৎসবে যোগ দেয়া পাকিস্তানী তরুণীদের জবানিতে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কেবল দুই দেশের সরকার এবং মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ। তারা বলেছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। একইভাবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারতের সাধারণ মানুষও যুদ্ধ চায়না,শান্তি চায়। মূলত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উত্তাপ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর ফলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হতে বাধ্য। একটি যুদ্ধ মানে হাজার হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ও বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ববরণের আশঙ্কা। জঙ্গিবাদী ছোবলে ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তান অথবা তিরিশ-চল্লিশ কোটি অতি দরিদ্র মানুষের ভারে ভারাক্রান্ত ভারত আরেকটি নতুন যুদ্ধে লিপ্ত হলে নিশ্চিতভাবেই সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং আরো কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে বাধ্য হবে। কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান কখনো রুদ্ধ হয়নি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে ‘ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসি’র ইতিবাচক ভূমিকা দেখা গেছে। দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোনালাপেই যখন যুদ্ধের আশঙ্কা কেটে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, পাকিস্তানের তরুণীরা শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে ভারতে পা’ রাখছেন। তখন পরিস্থিতিকে আরো ইতিবাচক ও গঠনমূলক পর্যায়ে উন্নীত করা অসম্ভব নয়। প্রথমত, কাশ্মির ইস্যুর গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী সমাধানই দুই দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা দিতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এই মুহূর্তে যুদ্ধের আশঙ্কায় স্থগিত হয়ে যাওয়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হলে শান্তির পক্ষে তা’ একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। শান্তি ও সম্প্রীতির মনোভাব ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেই সম্ভাবনাকে জাগ্রত করতে দুই পক্ষেরই করণীয় আছে। যুদ্ধের আশঙ্কা কেটে গিয়ে ইতিমধ্যে যেটুকু অর্জন হয়েছে তাতে উভয় পক্ষের ইতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় দুই দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ দেখা গেছে, একইভাবে যুদ্ধ বিরোধী সম্প্রীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। বিশেষত, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে শান্তির সপক্ষে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন