শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চাকরি জাতীয়করণ ও মাদরাসা শিক্ষা

প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মাদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী : এক ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগজনক গুঞ্জন, বাংলাদেশের মাদরাসা তথা বিশেষায়িত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করার দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে। যদি তা হয় তবে তা হবে, মাদরাসা শিক্ষা বিলুপ্ত করার এক সুদূরপ্রসারী প্রারম্ভ। এ ধরনের পদক্ষেপ হবে এদেশের সমগ্র আলেম সমাজ ও ইসলামপ্রিয় জনতার জন্য মারাত্মক দুঃসংবাদ।
আমাদের দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা সাধারণত দুই ধারায় বিভক্ত। এখানে আলিয়া পদ্ধতি নামে পরিচিত মাদরাসা শিক্ষার ওপরই আলোকপাত করতে চাই। এদেশের প্রাচীনতম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আলিয়া মাদরাসাকে বলা হয় উম্মুল মাদারেস বা মাদরাসাসমূহের জননী। এ মাদরাসার গৌরবময় অতীত নিয়ে বলার কিছু নেই, সবারই জানা আছে। ১৭৮১ সালে কলিকাতায় মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে ইংরেজ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলিকাতায় অবস্থিত ছিল এবং বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নানা স্থান থেকে সেখানে গিয়ে মুসলমান ছাত্ররা ইসলামের সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং শিক্ষা সমাপ্ত করে যার যার দেশে প্রত্যাবর্তন করতেন, ইসলামের সেবায় এবং জাতীয় কল্যাণে নানাভাবে নিয়োজিত থাকতেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর আলিয়া মাদরাসা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে আসে এবং এখানেই তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসা বিদেশীসহ তিনটি শাসন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে এবং সম্পূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার অস্তিত্ব অক্ষুণœ রেখে চলেছে। আলিয়া মাদরাসার নেসাব বা পাঠ্যসূচির অনুসারী এবং সরকার অনুমোদিত সর্বস্তরের মাদরাসাগুলোর সংখ্যা বর্তমানে কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসব মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এ যাবৎ বোর্ডের পাঠ্যসূচি সংস্কার হয়েছে বেশ কয়েকবার। এসব সংস্কারের সময় অর্থাৎ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের এবং ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তার প্রতি বিশেষ নজর রাখা হয়েছে।
আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যসূচিকে আধুনিকায়নের সূত্রপাত বহুকাল আগে কলিকাতায় হয় এবং ঢাকায়ও সে সংস্কার অব্যাহত আছে।
যুগোপযোগী তথা যুগের চাহিদা অনুযায়ী, কিছু কিছু নতুন বিষয় পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মাদরাসার সনদ নিয়ে কলেজ, বিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করছে এবং নানা বিষয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করছে এবং অনেক বিষয়ে তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে, তথাপি তাদের ক্ষেত্রগুলোতে তারা সুনাম অর্জন করে চলছে। এ যাবৎ অন্তত কয়েকশ’ মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছে।
মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা এ শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এর নানা দিক রয়েছে। যেমনÑ শিক্ষাপাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি, শিক্ষকের যোগ্যতা ও আচার-আচরণ তথা নৈতিক গুণাবলি, শরীয়তের অনুসরণ, কোরআন-হাদিস ও পাঠ্যসূচিভুক্ত কিতাবাদির প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন, উস্তাদগণের প্রতি শিক্ষাথীদের আদব-কায়দা, পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ, একাগ্রতা, সদাচরণ এবং শরীয়তের অনুসরণ ইত্যাদি আরো নানা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন। এসব উত্তম নীতিমালা প্রতিষ্ঠানে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে হলে প্রধান পরিচালককে হতে হবে এসব গুণের অধিকারী। তার আমল আখলাক ও কর্মপদ্ধতি হতে হবে ত্রুটিমুক্ত, তা না হলে তার অধীনস্থ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট সকলকে ইসলামী আদর্শ-শিক্ষার অনুকরণীয় প্রতীক হিসেবে কাজ করতে হবে। যার মধ্যে মাদরাসা শিক্ষার এসব স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার প্রতিফলন থাকবে ।
কোনো প্রতিষ্ঠান বিশেষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদের প্রতি কোনো জাতীয় সরকারের স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুমোদন এবং প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ বা জাতীয়করণ এক কথা নয়, উভয় প্রকারের মধ্যে বিরাট তফাৎ বিদ্যমান। বিশেষভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষার কথাই ধরা যাক। কওমি মাদরাসা পদ্ধতির কথা বাদ দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হাজার হাজার মাদরাসা প্রচলিত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সনদ সরকার অনুমোদিত ও স্বীকৃত। সরকার দ্বারা গঠিত বোর্ডের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে আসছে। সাধারণত এগুলো আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে অধিক পরিচিত। প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের ভাতা অনুদান প্রদান করা হলেও এগুলোকে সরকারি বা জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠান বলা যায় না। এরূপ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারি হওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্য ও গৌরবের বিষয়। বর্ণিত শ্রেণীর মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একমাত্র ঢাকা আলিয়া মাদরাসাই হচ্ছে সারাদেশের একক সরকারি মাদরাসা। সিলেট আলিয়া মাদরাসাকেও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ মর্যাদা প্রদান করা হয়ে থাকলে সরকারি মাদরাসার সংখ্যা হবে দুইটি। ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যসূচি বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নির্ধারিত এবং একই বোর্ডের অধীনস্থ মাদরাসাসমূহের পাঠ্যসূচিও এক ও অভিন্ন। এ একই অবস্থা মাদরাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হতে সর্বশেষ স্তর কামেল বা টাইটেল পর্যন্ত চালু রয়েছে, কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সব মাদরাসা এক ও অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসৃত হয়ে আসছে, এটি শত শত বছরের পাঠ্যসূচিগত ঐতিহ্য আর এ পাঠ্যসূচি যুগের পরিবর্তন ও চাহিদা অনুযায়ী এ যাবৎ অসংখ্যবার সংস্কার তথা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন ইত্যাদি করা হলেও নেসাব বা পাঠ্যসূচির মুল বিষয়গুলো অক্ষুণœ রয়েছে।
পক্ষান্তরে এসব মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে সেসব সুযোগ-সুবিধার বদলে যেসব অসুবিধা ও সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা বিদ্যমান, সেগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো দেশে কোনো সরকারই চিরস্থায়ী নয়। এক সরকার কোনো সৎ উদ্দেশ্যে কোনো জনকল্যাণমূলক প্রশংসনীয় কাজ করে গেলে পরবর্তী সরকার এসে তা বাদ করে দিলো অথবা কোনো ইসলামবিদ্বেষী কর্তৃত্ব ঐ দায়িত্ব গ্রহণ করে তার মতাদর্শ প্রয়োগ করতে চায় তা কেমন হবে? এরূপ অনাকাক্সিক্ষত দৃষ্টান্তের অভাব নেই। আমাদের দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এরূপ অজানা বিপদের মুখোমুখি করার আশঙ্কা অনেকের।
মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি সংস্কারে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদর্রেছীন সবসময় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। তার নিজের পক্ষ থেকেও খসড়া তালিকা পেশ করা হয়েছে। জমিয়াতুল মোদর্রেছীন পাঠ্যসূচিভুক্ত বিভিন্ন মৌলিক বিষয় বাদ না দেয়ার ব্যাপারে সবসময় দৃঢ় অবস্থানে। সংগঠনটি পাঠ্যসূচির ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্র্য যেন কোনো প্রকারেই ক্ষুণœ হতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলছে। এ ধরনের সতর্কতা না থাকলে মাদরাসায় আলেম ওলামার বদলে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষরাই থাকবেন। ঢাকা আলিয়ার প্রিন্সিপাল দেশবরেণ্য আলেম বা ইসলামী ব্যক্তিত্বের পরিবর্তে কেবল একজন গেজেটেড অফিসার আর প্রবীণ প্রফেসর বলেই বিবেচিত হবেন।
মাদরাসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও প্রবীণ উলামায়ে কেরামের মতে, মাদরাসা শিক্ষা এদেশে ইসলামের দুর্গ, এটা ধ্বংস করার জন্য ইসলামবিদ্বেষী একশ্রেণীর লোক আছে। তারা ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির ও বিরোধিতা করেছিল এবং সরকারকে এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও কম করেনি। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃঢ় মনোভাব ও সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিরাশ করেছে। এখন তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে এবং সরকারকে মাদরাসা জাতীয়করণ করার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।
বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে বলেন, জাতীয়করণ কথাটি শুনলে অনেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বেন। কেননা এতে রয়েছে উপকার ও গর্ব করার বস্তু, কিন্তু মাদরাসা শিক্ষাক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হলে তা হবে মাদরাসা শিক্ষাকে পঙ্গু করার শামিল। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mahmud ৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:৫৭ পিএম says : 0
waiting for your next article
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন