ড. এম এ সবুর
বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ৫ অক্টোবর। শিক্ষকদের নিকট দিবসটি আশাব্যঞ্জক। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এ হেন অবস্থায় দিবসটিতে দেশের শিক্ষকসমাজ উৎকণ্ঠিত। অথচ জাতি গঠনে ও জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান অসামান্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। জন্মদাতা হিসেবে মাতা-পিতা এবং শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। বাবা-মা ছাড়া যেমন জন্মগ্রহণ সম্ভব হয় না তেমনি শিক্ষক ছাড়া শিক্ষিত হওয়া যায় না। সন্তানদের যথাযথভাবে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের চেয়ে শিক্ষকের ভূমিকাই বেশি। এ কারণে মাতা-পিতার মর্যাদার ন্যায় গুরুজন বা শিক্ষকের মর্যাদাও অতুলনীয়। তাই ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বের সব দেশে-সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদা সর্বাধিক এবং তারাই সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থা তার উল্টো। এ দেশের শিক্ষকগণ সমাজে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। আর্থিক দৈন্যদশা ও সামাজিক বঞ্চনা বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে তাদের বঞ্চনা-দুঃখ-যাতনা বেশিরভাগই অব্যক্ত। অবশ্য তাদের দুর্বিষহ জীবনযাত্রার কিছু অংশ মাঝে মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশ পায়। অনেক সময় তাদের করুণ আর্তনাদ পত্রিকার পাতা ছাপিয়ে আকাশ-বাতাসেও ধ্বনিত হয়। আর বিবেকসম্পন্ন সচেতন মানুষকে এ আর্তনাদ আহত করে এবং আমাদের ন্যায়বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সাধারণত বাছাই করা সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের চেয়ে কম বিবেচনা করা হয়। একই সিলেবাস ও প্রশ্নের পরীক্ষায় পাশ করেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য ক্যাডারের চেয়ে নিচে! অধিকন্তু অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা মেনে চলতে হয় চাকরি ও পদবিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদেরকে! ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে! অধিকন্তু ¯œাতক পাস মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ খবরদারি করেন তাদের উপরে! লজ্জাজনক হলেও সত্য যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্নাতক পাস শিক্ষকদের বেতন কাঠামো অষ্টম শ্রেণী পাস সরকারি কর্মচারীদের সমান। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আরও কম! এখনও অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন বা ঝাড়–দাড়ের ব্যবস্থা নাই। আর ঐ সব বিদ্যালয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ যাবতীয় কাজ করতে হয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকেই! এছাড়া শিক্ষকদের সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য-বঞ্চনা তো আছেই।
একই পাঠ্যক্রমে ও একই নিয়মে পাঠদান এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমতা থাকলেও বেসরকারি শিক্ষকদের সাথে বৈষম্য করা হয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-স্ুিবধায়! জাতীয় স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হলেও তাদেরকে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতার ন্যায্য অধিকারসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি বেতনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) সুবিধা হতেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অধিকন্তু নিয়োগের বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে এবং এমপিও’র অজুহাতে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও বেতন-ভাতা হতে তাদেরকে বঞ্চিত ও হয়রানি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা না করে শুধু জ্যেষ্ঠতার কারণে পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা, প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকের আনুপাতিক হারের বেড়াজালে অপেক্ষাকৃত মেধাবী প্রভাষকগণকে সহকারী অধ্যাপকের পদ লাভে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রচলিত বিধানে। আর অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের কোন পদ না রেখে তাদের বঞ্চনার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন ও উচ্চতর গবেষণার জন্য পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না করে বেসরকারি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি/সদস্য স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত। অথচ তারাই খবরদারি করেন জাতি গঠনের মূল কারিগর ও দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতসমাজ শিক্ষকদের উপর! তারা বুঝে না বুঝে অনেক সময় শিক্ষকদের হয়রানির মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রদর্শন করে থাকেন। অনেক সময় তাদের অন্যায়-অসৎ দিকনির্দেশনা শিক্ষকদেরকে মানতে বাধ্য করেন! কারণ প্রচলিত বিধানে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকে। এতে শিক্ষকদের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়ে থাকে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, নন-এমপিও কলেজ-স্কুল, মাদরাসা, কিন্ডার গার্টেনসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোন বিধি-বিধান না থাকায় তাদের চাকরি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার উপর। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছাতে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তাই চাকরি রক্ষার্থে অনেক সময় আত্মমর্যাদা ভুলে শিক্ষকদের তোষামুদে হতে হয়! অধিকন্তু এসব বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতার সুনির্দিষ্ট কোন বিধি না থাকায় শিক্ষকদের চরমভাবে বঞ্চিত করা হয়।
সবচেয়ে করুণ অবস্থা নন-এমপিও (সরকারি অনুদান বর্হিভূত) শিক্ষকদের। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় অর্ধ লক্ষ শিক্ষক বেতন-ভাতা ছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ পাঠদান করছেন। পাঠদানের অনুমোদিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করছেন। কিন্তু অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় হলো এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য সরকার কোন বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করে নাই। আশ্চার্যের বিষয়, সরকার শিক্ষকদের পরিশ্রম করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জাতি তাদের পরিশ্রমের ফলও (ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা) ভোগ করছে অথচ শিক্ষকদের পারিশ্রমিক (বেতন-ভাতা) দেয়া হচ্ছে না! শিক্ষকদের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। সরকারি আশ্বাস ও দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এসব শিক্ষক চরম হতাশ ও বিপর্যস্ত। আর তাদের পারিবারিক জীবনযাত্রা দুদর্শাগ্রস্ত।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে আন্দোলন করতে হয়! আর এ আন্দোলন করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণকে নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়! এমনকি পুলিশি নির্যাতনে শিক্ষক নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ হেন বঞ্চনা-অবহেলায় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক ¯েœহস্পদ শিক্ষার্থীদের হাতেও লাঞ্ছিত হয়েছেন! জাতি গঠনের মূল কারিগর শিক্ষক সমাজের এ করুণ দশা জাতিকে লজ্জিত করে। তাদের বঞ্চনা-গঞ্জনা জাতীয় মানবতাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের নীরব আর্তনাদ সামাজিক বিবেক-বোধকে দংশন করে।
অস্বীকার করার উপায় নেই কিছু সংখ্যক অসৎ-অযোগ্য লোকও শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সংখ্যায় বেশি না হলেও তারা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অন্যায়-অপকর্ম ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে শিক্ষক সমাজের ভাব-মর্যাদা নষ্ট করছেন। অভিযোগ আছে অনেক শিক্ষক পেশা বর্হিভূতভাবে এনজিও, ব্যবসা, ঠিকাদারি ইত্যাদি কাজ করেন। অনেকে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অনেক শিক্ষক শ্রেণী কক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসা করে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন। তবে অত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোন শিক্ষকই প্রাইভেট পড়াতে চান না। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্য ঘুচাতে কোন কোন শিক্ষক প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। আবার ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষার ফলাফল ভালো করতেও অনেক শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন। যথাযথ সম্মান-মর্যাদা না থাকায় কোন কোন শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িতও হতে পারেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, শিক্ষকগণ আমাদের সমাজেরই অংশ। আর আমাদের সমাজের সর্বস্তরে দুর্বৃত্তদের ভয়াবহ চিত্র সবার কাছেই স্পষ্ট। তবে শিক্ষকসমাজ এসব অসৎ শিক্ষকদেরকে মোটেই পছন্দ করেন না বরং চরমভাবে ঘৃণা করেন। আর তাদের অনৈতিক কাজের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ থাকা আবশ্যক বলে মনে করেন।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকগণ জাতি গঠনের মূল কারিগর। কারণ শিক্ষার উন্নয়নের উপর নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন। আর শিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত শিক্ষকদের উন্নয়ন। শিক্ষকদের উন্নয়ন বলতে বোঝায় তাদের যোগ্যতা-দক্ষতা, জ্ঞান-সৃজনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়ন। অধিকন্তু শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে কর্তব্যনিষ্ঠ এবং নৈতিকতাসম্পন্ন হওয়া শিক্ষান্নোয়নের অন্যতম শর্ত। পাশাপাশি শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। আর এসব ব্যবস্থার জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বা বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এমনি প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকগণের প্রত্যাশা শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সকল শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ এবং শিক্ষকদের সব বঞ্চনা-বৈষম্য দূরীকরণ।
য় লেখক : শিক্ষক ও আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন