শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

যুগে যুগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে শুধু যে পাকিস্তান আমলেই ষড়যন্ত্র হয় তা নয়। বাংলা ভাষার দুর্ভাগ্য এমনই যে, এ ভাষার শৈশব থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প-িতগণের মতে, বাংলা ভাষার জন্ম হয় সপ্তম শতাব্দীতে ইন্দো-এরিয়ান ভাষা পরিবারে দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বাংলার প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া যায় ‘বৌদ্ধ গান ও দোহ’া এর মধ্যে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের শাসনামলে বাংলা ভাষার জন্মকালটা বেশ সুখে কাটলেও অচিরেই এই ভাষাকে আঁতুড়ঘরেই গলাটিপে মারার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
একাদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আগত গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজারা পাল রাজবংশকে উৎখাত করে এদেশে সেন বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সেন রাজারা শুধু সমাজে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টিকারী জাতিভেদ প্রথাই প্রবর্তন করেন না, জনগণের ব্যবহৃত বাংলা ভাষার বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র শুরু করে দেন। তারা সংস্কৃতকে রাজ ভাষার মর্যাদা দিয়ে জনগণের ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করতে থাকেন। শাসকদের এ মানসিকতায় উৎসাহিত হয়ে ব্রাহ্মণ প-িতরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সংস্কৃতকে তারা দেবতার ভাষা এবং বাংলাকে সাধারণ মানুষের ভাষা আখ্যায়িত করে জারি করা এমনি একটি সংস্কৃত শ্লোক ছিল নি¤œরূপ :
অষ্টদশ পুরান রামায়স্যাম চরিতানিচো
ভাষায়াং মানবং শ্রুত রৌঢ়ব নরকং ব্রজেত।
অর্থাৎ যারা মানব রচিত বাংলা ভাষায় অষ্টাদশ পুরান ও রামায়ণ শ্রবণ করবে, তাদের স্থান হবে রৌঢ়ব নরক।
সৌভাগ্যক্রমে এই রাষ্ট্রীয় সামাজিক পটভূমিতে ১২০৩ সালে ইফতিখারুদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা জয় করেন। বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শুধু জাতিভেদ লাঞ্ছিত তদানীন্তন সমাজেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় না, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির ইতিহাসেও এক গৌরবময় অধ্যায়ের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে প্রায় ছয়শ বছরের মুসলিম শাসনামলে ফার্সি ছিল সরকারি ভাষা, তবুও বাংলা ভাষার চর্চা মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সমর্থ হয়। আরও উল্লেখযোগ্য যে, শাসকদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষায় ইসলামী ও অনৈসলামী গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হতো না। ফলে সে সময় যেমন আরবি ও ফার্সি তেমনি সংস্কৃত থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়।
বিখ্যাত গবেষক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন এ প্রসঙ্গে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করিয়া থাকে, বাংলা ভাষা তেমনি কোনো শুভদিন শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতে ছিল। মুসলিম বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভদিন শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। [দ্রষ্টব্য : বাংলা ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন]। এতে প্রমাণিত হয়, যদিও বাংলা ভাষার জন্ম হয় বৌদ্ধ আমলে, নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে শৈশব ও কৈশোরে এ ভাষার লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করেন মুসলিম শাসকগণ।
মুসলিম শাসকদের উৎসাহে মধ্য যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটায় মুসলিম সমাজে ব্যবহৃত প্রচুর আরবি, ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ে। তবে এসব সত্ত্বেও মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কিছু দ্বিধা অনুভব করতেন। যেহেতু এ ভাষা কোরআনের ভাষা ছিল না। এ ধরনের দ্বিধা ফার্সি ভাষার কবি-সাহিত্যিকরা অনুভব করতেন না। কারণ ফার্সি আরবি থেকে স্বতন্ত্র ভাষা হলেও এর লিপি ছিল আরবি। বাংলাভাষী মুসলমানদের অনেকের মধ্যে এই দ্বিধা আরও গভীর হয়ে ওঠে, যখন মোঘল শাসনের পতন যুগে উত্তর ভারতে মৌখিক হিন্দি ভাষার সঙ্গে আরবি লিপির সংযোজন ঘটিয়ে উর্দু ভাষার জন্ম হয়।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক জীবনে প্রায় এসময়েই ১৭৫৭ সালে ঘটে পলাশীর মহাবিপর্যয়। পলাশীর বিপর্যয়ে শুধু আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সূর্যই অস্ত যায় না, মুসলিম রাজশক্তির কাছ থেকে শাসক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া নব্য ইংরেজ শাসকদের একটা নীতি হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, ভূমিনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি সমাজের সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে মুসলমানদের উৎখাত করে সেসব স্থানে ইংরেজ অনুগত হিন্দুদের বসানো। এই নীতি অনুসরণেই ১৭৯৩ সালে পূর্বতন ভূমি ব্যবস্থা বদলিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে নতুন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, তার মাধ্যমে ইংরেজ অনুগত এক নব্য জমিদার গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়, যার বেশির ভাগই ছিল হিন্দু।
এই একই নীতির অনুসরণে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহু আরবি ফার্সি শব্দ বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণ প-িতদের সাহায্যে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের বহুল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এক ধরনের সংস্কৃত-কণ্টকিত বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টা চালান নব্য শাসকরা। এর ফলে অনেক মুসলিম সাহিত্যসেবী অভিমান করে বটতলায় পুঁথি সাহিত্য রচনার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য পিপাসা মেটানোর চেষ্টা করেন। অনেকে এখনো ভারতে থাকেন, বাংলা নয়, উর্দু তাদের নিজস্ব ভাষা। তবে কিছু দিনের মধ্যেই এসব সাহিত্যসেবী তাদের ভুল বুঝতে পারেন এবং উনিশ শতকের শেষার্ধেই মীর মশাররফ হোসেন, শেখ আবদুর রহিম, মোজাম্মেল হক, কায়কোবাদ প্রমুখ মুসলমান কবি-সাহিত্যসেবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে শেখ হাবিবুর রহমান সাহিত্যরতœ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা আকরাম খাঁ, জসীমুদ্দিন, গোলাম মোস্তফা, বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে মুসলিম কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পুনরায় তাদের গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি শুরু করেন।
সর্ব ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরিম-লে হিন্দুদের হিন্দিপ্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের মধ্যে উর্দুর প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধী একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এক পত্রে জানতে চেয়েছিলেন ভারত স্বরাজ লাভ করলে সাধারণ ভাষা কী হবে? এর জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, একমাত্র হিন্দিই আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগের ভাষা হতে পারে। তবে বিখ্যাত বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, বাংলা, হিন্দি ও উর্দু এ তিন ভাষা ভারতের সাধারণ ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। [দ্রষ্টব্য : মোসলেম ভারত, কলিকাতা, বৈশাখ ১৩২৭ বাংলা সন]।
প্রায় দু’শ বছর ইংরেজ রাজত্বের অবসানে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে সে সম্বন্ধে কংগ্রেস পূর্বেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ায় এ সম্পর্কে সমস্যা থেকে যায়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবে বাস্তবতা বিবেচনায় উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। ১৯৪৭ সালে যদি লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটত, তাহলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো সমস্যাই হতো না। এমন কি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের বাইরে সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু সেটাও যদি সফল হতো তাহলে সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হতো বাংলা। এ আন্দোলনের প্রতি মুসলিম লীগ হাইকমান্ডের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ অবাঙ্গালী কংগ্রেস নেতা এবং বাঙালি হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বিরোধিতায় এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। শেষোক্ত ব্যক্তি তখন এমনও বলেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে নাকি বাঙালি হিন্দু চিরদিনের জন্য বাঙালি মুসলমানের গোলাম হয়ে যাবে। অর্থাৎ তার কাছে বাঙালি মুসলমানের চেয়ে অবাঙালি হিন্দুর আধিপত্য অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল।
যাইহোক, লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং অখ- সার্বভৌম বাংলা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। যদিও জনসংখ্যা বিচারে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ ছিল পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃ ভাষা ছিল বাংলা, তবুও নতুন রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ আমলাদের মধ্যে উর্দু ভাষীদের সংখ্যাধিক্য থাকায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার গোপন প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের ব্যবহৃত পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহার থেকে। এতে পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত জনসচেতন অংশের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সন্দেহ দেখা দেয়। এ পটভূমিতেই ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিস ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের মেনিফেস্টোরূপী “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন শুরু করে দেয়।
এ পুস্তিকায় তিনটি নিবন্ধ স্থান পায়। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ও খ্যাতনামা সাংবাদিক-সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ আবুল মনছুর আহমদের লিখিত এ তিনটি নিবন্ধের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এবং তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম লিখিত “আমাদের দাবি” শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবিসমূহ তুলে ধরা হয় এভাবে :
“১। বাংলা ভাষা হবে :
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।”
প্রধানত এই দাবির ভিত্তিতেই ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়। শুধু পুস্তিকা প্রকাশ করে ও দাবি জানিয়েই তমদ্দুন মজলিস বসে থাকেনি। এই দাবিতে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তি সংযোগ, আলোচনা সভা এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে। ১৯৪৭ সালেই ফজলুল হক হলে হাবীবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় তার উদ্যোগে। ১৯৪৭ সালেই মওলানা আকরম খাঁসহ বহু সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষরসহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি স্মারকলিপি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের লেকচারার অধ্যাপক নুরুল হক ভূইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার যে বিষয়বস্তুর তালিকা প্রকাশিত হয় তাতে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি এমনকি মৃত ভাষা ল্যাটিন সংস্কৃত স্থান লাভ করলেও বাংলা ভাষা না থাকায় তার বিরুদ্ধে এক বিবৃতি দেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। তখনকার দিনে ঢাকায় কোনো দৈনিক পত্রিকা ছিল না। ওই বিবৃতি কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় ৩১ ডিসেম্বর (১৯৪৭) এবং তার সঙ্গে ‘অবিশ্বাস্য’ শীর্ষক একটি কড়া সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকা ঢাকায় এসে পৌঁছলে এ প্রশ্নে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ দাবি করলে সে দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এর বিরুদ্ধে তমদ্দুন মজলিস ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এখানে উল্লেখ যে, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্বতন বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের একটি স্বতন্ত্র ছাত্র সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই প্রতিষ্ঠানও ভাষা আন্দোলন সমর্থন করায় মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। ১১ মার্চ সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে ভাষা আন্দোলনকারীদের কড়া পিকেটিংয়ের ফলে খুব কম কর্মকর্তার পক্ষেই সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। পিকেটারদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। অন্যদেরকে পুলিশ লাঠিচার্জ করায় এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরও প্রবল আকার ধারণ করে। সেক্রেটারিয়েট এলাকায় অরাজকতা শুরু হয়। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। তদানীন্তন চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন এতে ভীত হয়ে পড়েন। কারণ ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফরের কথা। তাই নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ তারিখেই ভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তিস্বাক্ষর করেন। অবস্থা আপাতত শান্ত হয়। এই খাজা নাজিমুদ্দিনই ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এসে ঢাকায় পল্টন ময়দানে ঘোষণা করেনÑ উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ফলে তার বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনতা গর্জে ওঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ঘোষণা করে। ওই দিন সরকারের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ভাষা সংগ্রামীরা যে রক্তাক্ত ইতিহাস সৃষ্টি করেন তাতে ভাষার দাবি প্রকাশ্যে অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তবে এর পরও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনকালে এক শ্রেণীর বামপন্থি অযাচিতভাবে বাংলার সঙ্গে পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করলে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল গফুর প্রমুখের বিরোধিতায় সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র এর পরও থেমে নেই। সর্বশেষ বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে চলছে হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। অন্যদিকে তার পাশাপাশি বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহারের বিরুদ্ধে এক শ্রেণীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পরিকল্পিত অনীহা। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র কবে শেষ হবে, কে জানে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন