শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কিশোর অপরাধ কেন বাড়ছে?

সৈয়দা আনিকা বুশরা | প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

দ্বি-মত হবার কোনো সুযোগ নেই যে, করোনাকালীন সময়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের ঘরে বসে সময় কাটাতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের বিনোদনের কথা চিন্তা করে হাতে তুলে দিচ্ছে স্মার্টফোন, ট্যাব কিংবা ল্যাপটপ। কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাসের খাতিরে বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে কিশোর-কিশোরীরা খুব সহজেই ইউটিউব, টিকটক, লাইকি, ফেইসবুক, বিভিন্ন গেইম এমনকি পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় আবার বাবা-মা সন্তানের প্রাইভেসির কথা চিন্তা করে আলাদা কক্ষ দিয়ে থাকে। তবে তারা কী করে, তা সঠিকভাবে তদারকি করেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সাইডগুলোতে কিশোররা ভয়ঙ্করভাবে আসক্ত হয়ে এবং অনেক সময় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হতে প্ররোচিত হচ্ছে। কিশোরদের ভিতর ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলছে। সুতরাং পরিবার, আর খুব সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাবা-মার কিছু দায়িত্বহীনতা শিশু-কিশোরদের অপরাধমুখী করে তুলছে।

সম্প্রতি সময়ে টিকটকের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে রাতারাতি খ্যতি এবং পরবর্তীতে টিকটককে কেন্দ্র করে ধর্ষণ, মাদক এমনকি নারী পাচারের মতো অপরাধে কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। বর্তমান সময়ে আলোচিত কিছু ঘটনা স্বভাবতই মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিশোর অপরাধী টিকটকার অপুর রাতারাতি মডেল বনে যাওয়া এবং মিডিয়াতে কাজ করা কতটুকু যুক্তিসংগত? পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি একজন অপরাধীকে সমাজ ভালো কিছু করবার সুযোগ দেবে না? অবশ্যই দেবে, তবে রাতারাতি টিকটকের মাধ্যমে খ্যতি পাওয়া একজন অপরাধী কিশোরকে যখন মিডিয়ার মতো জায়গায় কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়, তখন স্বাভাবিক সমাজের আরও ১০ জন কিশোর তাকে অনুসরণ করার পথ বেছে নেবে। সুতরাং দেখা যায়, এর মাধম্যে টিকটকের নেতিবাচক দিকটিকে আরও প্রচার করা হচ্ছে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা পরিবারকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। একজন মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে পরিবারের সাথে। উল্লেখ্য বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ কিশোর অপরাধী পরিবারের সংলগ্নে বড় হয়। তাহলে বলাই বাহুল্য যে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে হয়তো পরিবার ব্যর্থ হচ্ছে তাদেরকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানে। বাবা মায়ের ভিতর অন্তর্দ্বন্দ্ব, ডিভোর্স অথবা পরিবারের কেউ অপরাধ কর্মকান্ডে যুক্ত থাকা অনেক সময় একজন কিশোরকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। দারিদ্র্য বা অভাব-অনটন যে কিশোর অপরাধের আর একটি কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার খাতিরে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আশা কিশোররা চুরি, পকেটমার, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। কিশোর অপরাধ সংঘটনে পরিবেশের দায় এড়ানোর মতো নয়। পরিবার থেকে বের হয়ে একটি শিশু যখন ভয়ংকর পরিবেশের সম্মুখীন হয় তখন পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে আমরা একটা চরণের সাথে সবাই পরিচিত ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে।’ শুরু থেকেই অর্থ উপার্জন করা আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে বেঁধে দেয়া হয়। একজন কিশোর যখন দেখতে পায় তার স্কুল বা কলেজের মেধাবী ছেলেটা বার বার চেষ্টা করেও ভালো চাকরি পাচ্ছে না অন্যদিকে এলাকার কোনো বড়ভাই নামে মাত্র পড়াশোনা করে ক্ষমতাধর দলের ছত্রছায়ায় নানান অপরাধ কার্যক্রম করে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক। তখন সে দ্বিতীয় রাস্তাটাকেই লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেবে। ঢাকার উত্তরা বা মোহাম্মদরপুর এলাকায় এরকম অসংখ্য কিশোর গ্যাং পাওয়া যায়, যারা নিজে এলাকায় অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকান্ডের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়েছে।

যখন কোনো কিশোর অপরাধ সংঘটন করে তখন তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে ক্রম বর্ধমান অপরাধের তুলনায় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক কম। সারাদেশে মাত্র তিনটি সংশোধন কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল অপরাধীদের ভালো হতে শিক্ষা দেয়া, বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দেয়া, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব সংশোধন কেন্দ্রে তারা বিভিন্ন মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। যার মূল কারণ কর্মচারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব এবং জবাবদিহির অভাব। আরও উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন অপরাধীদের একসাথে রাখার ফলে পরবর্তীতে এর নেতিবাচক বিভিন্ন প্রভাব পড়ে তাদের উপর। সংশোধন কেন্দ্র থেকে মুক্তির পর এসব ছোট অপরাধী (চুরি, পকেটমার) দেখা যায় বড় অপরাধে (খুন, ধর্ষণ) লিপ্ত হয়ে পড়ছে।

আজকের কিশোর আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের হাত ধরেই দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। কিশোর অপরাধের দায় রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবার, কেউই এড়াতে পারবে না। কিশোর সংশোধন কেন্দ্র বাড়িয়ে, দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মচারীদের মাধ্যমে কিশোরদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দরিদ্র কিশোরদের যথাযথ কারিগরি শিক্ষা, প্রদান করতে হবে। সংশোধন কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদারকির ভিতরে রাখতে হবে। কিশোরদের জন্য সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে বিনোদনের ব্যবস্থা, শরীর চর্চা, ধর্মশিক্ষা, নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তারা সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এবং একটি সুন্দর সমাজে সদস্য হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৩৪ পিএম says : 0
Root cause is that our beloved country is ruled by crooks, if our country rule by Allah's Law then all these can be prevented. In Islam prevention is better than cure.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন