শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

করোনা মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি সারাবিশ্বের অর্থনীতিকে চরম মন্দাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো অর্থনীতি সচল করতে হিমশিম খাচ্ছে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে একমাত্র দেশ হিসেবে কেবল চীনই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতির গতি সচল রাখতে পেরেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের কারণেই তার পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছে। বৈশ্বিক এই মন্দাবস্থার মধ্যে বাংলাদেশও পড়েছে। মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, আয় কমে যাওয়া এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধিসহ অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নগামী। লকডাউনের কারণে সরকারের নেয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক মেগা প্রকল্প ছাড়া অন্য ছোট ও মাঝারি আকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির উপর পড়েছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেট ঘোষণার পর চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার মন্থর হয়ে পড়েছে। এ সময়ে উন্নয়ন কর্মসূচির হার মাত্র ৩.৫২ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে এই হার ছিল ৩.৮৯ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুসারে, প্রথম দুই মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের ১৫৯১ প্রকল্পের বিপরীতে খরচ করা হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সরকারের ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার দুই মাসের অগ্রগতি বা খরচের হার এক শতাংশের নিচে। এর মধ্যে তিন মন্ত্রণালয় ও চার বিভাগ গত দুই মাসে প্রকল্পে কোনো টাকা খরচ করেনি। লকডাউন উঠে যাওয়ায় অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেখানে সরকারের প্রকল্পগুলো অত্যন্ত দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে সচল করা দরকার, সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের উল্লেখিত চিত্র অত্যন্ত হতাশার ও দুঃখজনক।

করোনায় দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র বিগত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সংস্থা জরিপের মাধ্যমে তুলে ধরেছে। এসব জরিপ থেকে জানা যায়, করোনার কারণে নতুন দরিদ্র হয়েছে দুই থেকে তিন কোটি মানুষ। দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশের উপরে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে দেশের প্রায় ছয় কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনেকে চাকির হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকের বেতন কমে গেছে। রাজধানীতে টিকতে না পেরে পঞ্চাশ লাখের বেশি মানুষ গ্রামে ফিরে গেছে। অনেকে গ্রামে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে। গ্রামে গিয়েও যে তাদের কর্মসংস্থান হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। জীবন-জীবিকার তাকিদে অসংখ্য মানুষ পেশা বদল করে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। সম্মানজনক পেশা ছেড়ে কেউ কেউ সবজি বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা কিংবা রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহে বাধ্য হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্তরা দরিদ্র এবং অনেক মধ্যবিত্ত নিন্মবিত্তে পরিণত হয়েছে। করোনার এই পরিস্থিতিতে ধনী শ্রেণী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ছাড়া অন্য সবশ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তারা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হাতের নাগালের বাইরে থাকায় সাধারণ মানুষের পক্ষে দুবেলা খাবার জোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। সন্তানের স্কুলের বেতন, যাতায়াত খরচসহ অন্যান্য খরচও বাড়ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তারা কিভাবে চলবে, কেমন করে জীবিকা নির্বাহ করবে, তার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। বেকার হয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই বা কিভাবে হবে তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। দেশের সব অর্থনৈতিক সূচক নিম্নগামী হওয়ায় দুশ্চিন্তার অবধি নেই। করোনার মধ্যে বৈদেশিক রিজার্ভ রেকর্ড করলেও এখন তা কমে আসছে। শ্রমশক্তি রফতানিতে ধস নেমেছে। রেমিট্যান্স কমছে। কবে তা ঘুরে দাঁড়াবে তার নিশ্চয়তা নেই। দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিনোয়োগ বলতে কিছু নেই। করোনা পরিস্থিতিতে তা আরও কমেছে। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তাবয়নের হারও ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পূর্নোদ্যমে চালু করা গেলে এর মাধ্যমে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। এক্ষেত্রে কোনো গতি দেখা যাচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টরা করোনার অজুহাতে অনেকটা হাতগুটিয়ে বসে আছে। মূলত তাদের এই শৈথিল্যর কারণে প্রকল্পগুলো গতি পাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতিকে দাঁড় কারাতে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু ও শেষ করা অপরিহার্য। আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আর্থিক নিশ্চয়তা ও সুযোগ-সুবিধা থাকায় দায়িত্ব পালনে তাদের মধ্যে গাফিলতির প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের কর্মচারি হয়ে জনগণের কল্যাণে আত্মনিবেদনের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তা নাহলে, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করা এবং গতি আনার ক্ষেত্রে এতটা উপেক্ষা পরিলক্ষিত হতো না।

উন্নত দেশগুলো করোনা পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেছে। করোনা থাকবে এবং একে সঙ্গে করেই চলতে হবে, এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, করোনাকে সঙ্গী করে দেশকে এগিয়ে নেবেন। মালয়েশিয়া করোনাকে স্বাভাবিক একটি রোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে এমন মনোভাব নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। করোনার অজুহাত দেখিয়ে উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ রাখা বা ধীরলয়ে চলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে আমরা অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে ঢুকে গেছি। অর্থনৈতিক সংকটে কোটি কোটি মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এসব মানুষকে স্বস্তি ও সুরক্ষা দিতে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল করা ছাড়া বিকল্প নেই। বেকার হয়ে পড়াদের কিভাবে দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, এ নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করা দরকার। যেভাবেই হোক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনা আমাদের অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এই পিছিয়ে পড়াকে অতিক্রম করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অধিক তৎপর হতে হবে। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন