শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলাধুলা

একটি স্টেডিয়ামের নীরব কান্না

মো. জাহিদুল ইসলাম ও মো. হাফিজুর রহমান মিন্টু | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

চারদিকে থৈ থৈ পানি। ভেতরের অবস্থা যেন আরও ভয়াবহ। দূর থেকে দেখে যে কেউ বলবে, এটি একটি খাল বা বিলের অংশ। ঠিক এমনই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের। পানিবদ্ধতা আর সংস্কারের অভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আইসিসির আন্তর্জাতিক ভেন্যুর মর্যাদাপ্রাপ্ত এ স্টেডিয়ামটি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো অচিরেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হতে পারে স্টেডিয়ামটি। অথচ, বিসিবির আবেদনে মোটা অংকের অর্থ ব্যয়ে স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করেছিল বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)।
নারায়ণগঞ্জ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে ঢাকা ডিভিশনের আসর জমতো ফতুল্লার এই আউটার স্টেডিয়ামে। যেখানে সবুজ ঘাসের সমারোহে ব্যাট-বলের দারুন মিতালিতে মন জুড়াতো ক্রিকেটপ্রেমীদের, সেখানে এখন ঠাঁই পেয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত পানি আর গজে উঠেছে কচুরী পানা। দূর্গন্ধের পাশাপাশি ছড়াচ্ছে রোগ জীবাণু। এছাড়া জমে থাকা পানি এখন পরিণত হয়েছে নানা পোকামাকড় আর মশার আতুর ঘরে। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার উৎপাতে ওষ্ঠাগত এলাকার জনজীবন।
আউটার স্টেডিয়ামের পাশেই চোখে পড়বে মূল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটি। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটির অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত। প্রেসবক্স, কমেন্ট্রিবক্স এমনকি ড্রেসিংরুমের বেশ কিছু অত্যাধুনিক জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ে আছে! মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনও অকেজো। গ্যালারীর দেয়ালে দেয়ালে জমেছে শ্যাওলা। গ্যালারিতে দর্শকদের রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার ছাউনিটিও ভেঙে গেছে। বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করার সময় যে কারও কাছে মনে হবে, এটি একটি পরিত্যক্ত জায়গা। মাঠের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন সড়কে গজে উঠেছে আগাছা।
স্টেডিয়ামের দক্ষিন পাশেই অবস্থিত ইনডোর। ইনডোরের সকল অবকাঠামো ভেঙ্গে চুরমার। যেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত স্থাপনায় রূপ নিয়েছে ইনডোরটি। স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের ৪টি টাওয়ারের সবগুলোই অকেজো। প্রেসবক্স ও কমেন্ট্রিবক্সে লাগানো এসিগুলোও অকেজো হয়ে পড়েছে। এসির বাহ্যিক যন্ত্রাংশে মরিচা ধরে ভেঙ্গে পড়েছে। টয়লেট ও ওয়াশরুমের অবস্থাও করুণ। পানির কলগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। স্টেডিয়ামের পাঁচটি প্রবেশ পথের চারটিই পানির দখলে। গেট পার হয়ে স্টেডিয়ামে যেতে হাঁটার ৩ মিনিটের পথ ও অনুশীলনের জায়গাজুড়েই কোমর পানি। গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা সব মৌসুমেই বছরের পর বছর এভাবেই জমে থাকে পানি। এতে চরম দুর্গন্ধ তৈরি হয়েছে। জমে থাকা পানিতে জন্মেছে নানা জলজ উদ্ভিদ। একটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের এমন কান্না ছুঁয়েছে নগরবাসীর, তবে উদাসীন সংশ্লিষ্টরা!
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে যাত্রা শুরু করা এই স্টেডিয়াম দীর্ঘ ১৭ বছরে ম্যাচের সাক্ষী মাত্র ৮টি! ২০০৬ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ বনাম কেনিয়ার ওয়ানডে ম্যাচর মাধ্যমে ২৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামটির যাত্রা শুরু। ঐ বছরের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচ দিয়েই শেষ হয় একদিনের ম্যাচের ইতিহাস। ২০০৬ সালের ৯-১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ম্যাচের মাধ্যমে শুরু হয় স্টেডিয়ামটির টেস্টের ইতিহাস। এরপর ২০১৫ সালের ১০-১৪ জুন বাংলাদেশ বনাম ভারতের টেস্ট ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে শেষ হয় এই স্টেডিয়ামের টেস্ট ম্যাচের ইতিহাস। আর ২০১৬ সালের এশিয়া কাপ বাছাইয়ের চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সাক্ষী এই স্টেডিয়ামটি। যদিও একটি ম্যাচও খেলতে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয় দল। বর্তমানে মাঠটিতে দু-একটি ক্লাবের খেলা ও বিভিন্ন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হলেও মাঠের চারদিকে পানির কারণে সেটাও বন্ধ।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই ক্রিটেকপ্রেমী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে এ মাঠেও ম্যাচ দেখেছেন স্থানীয়রা। প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারি উপচে পড়েছিল দর্শকে। বানিজ্যিকভাবেও এই মাঠ কখনো নিরাশ করেনি বিসিবিকে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বরাবরের মতো অবহেলিত থেকে গেছে ফতুল্লার আন্তর্জাতিক এই স্টেডিয়ামটি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাঠের জায়গাটিতে এক সময় জলাভূমি ছিল। নির্মাণের সময় আশপাশে বসতবাড়ি বেশি না থাকলেও এখন বসতবাড়ির পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ফলে অন্যান্য জায়গা থেকে মাঠটি এখন নিচু হয়ে গেছে। যে কারণে সবসময় মাঠটিতে পানি জমে থাকে। কর্তৃপক্ষও পানি সরানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্টেডিয়ামটি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য নিরাপত্তাকর্মী ও মাঠকর্মীসহ মোট জনবল রয়েছে ৫০ জন। এরা প্রত্যেকেই স্টেডিয়ামে নির্মিত সরকারী ডরমিটরিতেই থাকেন। ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য স্টেডিয়ামে দু’টি কোয়ার্টারও রয়েছে। এর মধ্যে একটি একতলা এবং অপরটি বহুতল ভবন। মাঠ রক্ষায় নিয়োজিতরা মাসে মাসে নির্ধারিত বেতন ও অন্যান্য ভাতা সমূহও ভোগ করছেন। কিন্তু মাঠ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষনে বিভিন্ন সেক্টরে সরকারের নিয়োগকৃত অর্ধশত লোক থাকা সত্বেও আন্তর্জাতিক এই ভেন্যুটি পর্যাপ্ত পরিচর্যাহীনতায় আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত, যা নিয়ে ক্ষোভ জন্মেছে স্থানীয়দের মনে।
বিসিবি, এনএসসি কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের চরম এই উদাসীনতায় হতাশা প্রকাশ করতে শোনা গেছে খোদ নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক তানভির আহমেদ টিটুকেও। তিনি অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার এখানে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একটা মাঠ দিনের পর দিন এভাবে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে অনেক দিন, এটা দুঃখজনক।’ তবে এই তিন প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতার একটি কারণও বের করেছেন টিটু। দেখালেন সমাধানের পথও, ‘এই অব্যবস্থাপনার মূল কারণ হচ্ছে, স্টেডিয়ামটি পড়েছে ডিএনডির ভেতরে। বর্তমানে ডিএনডির অনেকগুলো এলাকা পানির নিচে। ডিএনডি এলাকার চিত্রেরই একটা অংশ এই স্টেডিয়াম। ডিএনডির কাজগুলো সম্পন্ন হলে তখন হয়তো চিরস্থায়ী সমাধানে আসা যাবে।’
অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা গেল খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে থাকা রুহুল আমিনকেও, ‘আমাকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বে রাখা হলেও সংস্কারের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাকে কোনো বাজেট দেয়া হয় না। সংস্কারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদের উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে এখানে যারা কাজ করে তাদের কোনো সমস্যা হয় কিনা বা বিসিবির বাইরে অন্য কেউ খেলে কি না, সে ব্যাপারে দেখাশোনা করা।’
তবে কিছুটা আশার কথা শোনালেন এনজেকেএস সাধারণ সম্পাদক টিটু, ‘আমি যতটুকু জানি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ যৌথভাবে বুয়েটের মাধ্যমে তারা এটা সার্ভে করিয়েছে, কীভাবে করলে ভালো থাকবে। বুয়েট অলরেডি তাদের সার্ভে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দায়িত্ব। তারা যেকোনো সময় কাজ শুরু করবো আবার খেলা শুরু করার জন্য।’
মিরপুরের শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো ফতুল্লা স্টেডিয়ামটির মালিকানাও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। তবে ফতুল্লা স্টেডিয়াম দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু বর্ষা মৌসুম আসলেই পানি জমে যায়, খেলার অবস্থা থাকে না। এজন্য ফতুল্লার ড্রেনেজ সিস্টেম ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি নিয়ে কাজ শুরু করেছে বিসিবি। সংস্থটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন বলেন, ‘ইতোমধ্যে ফতুল্লার ড্রেনেজ সিস্টেম ও পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। বুয়েটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডিটেইল ড্রয়িং ডিজাইন করার জন্য। বুয়েট সেই ডিজাইন সাবমিট করেছে এবং আমরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে পাঠিয়েছি। আমরা আশা করছি এনএসসি শীঘ্রই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং স্টেডিয়ামটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’
জেলার নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়সহ ক্রীড়াপ্রেমীদের দাবি, অচিরেই যাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাঠের দিকে নজর দেয়। না হলে একদিন ঐতিহ্য হারাবে খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। সংকটে পড়বে তার অস্তিত্ব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
এস এম আকবর ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:৪০ এএম says : 0
এগুলো দেখার কি কেউ নেই?
Total Reply(0)
হাবিব ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:৪৭ এএম says : 0
এত টাকা খরচ করে স্টেডিয়াম করে যদি না্-ই খেলতে পারে তাহলে কি লাভ ?
Total Reply(0)
গোলাম কাদের ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:৪৮ এএম says : 0
দ্রুত এটিকে খেলার উপযোগী করে তোলা হোক
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন