শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

ফুসফুসের রোগ নির্ণয় ও উন্নত চিকিৎসা

| প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম | আপডেট : ১২:১৭ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে বাতাস আদান প্রদানের অরগান হল ফুসফুস। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে ফুসফুস জনিত বিভিন্ন জিজ্ঞাসা সম্পর্কে কথা বলেন ভারতের বিখ্যাত ইয়াশোদা হসপিটাল, হায়দ্রাবাদ-এর কনসালটেন্ট পালমোনোলজিস্ট ডা. চেতান রাও ভাদেপালি।

ফুসফুস জনিত রোগ, রোগের উপসর্গ এবং প্রাথমিকভাবে করণীয় সম্পর্কে ডা. চেতান রাও-এর কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, “ফুসফফুসের রোগকে শ্বাসনালী, ফুসফুসের প্যারেনকাইমাল এবং প্লুরাল রোগে ভাগ করা যায়। শ্বাসনালীর রোগের মধ্যে প্রধানত হাঁপানি, সিওপিডি, শ্বাসনালীর টিউমার সহ অন্যান্য এন্ডোব্রোনকিয়াল সংক্রমণ অন্তর্ভুক্ত। প্যারেনকাইমাল রোগ যেমন; ফুসফুসের ইন্টারস্টিশিয়াল রোগ, ক্যান্সার, সংক্রমণজনক রোগ (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস, যক্ষ্মা) ইত্যাদি, প্লুরাল রোগ যেমন; ইফিউশন, নিউমোথোরাসেস, হেমোথোরাক্স ইত্যাদি রোগও ফুসফুসের রোগ হিসেবে পরিচিত। শ্বাসকষ্ট, কফ-সর্দি সহ বা ছাড়াও কাশি, হাঁচি, বুকে ব্যথা ইত্যাদি ফুসফুস জনিত রোগের প্রধান উপসর্গ। কারও মধ্যে এসব উপসর্গ দেখা গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হবে। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে অবশ্যই পালমোনোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। উপসর্গগুলো ২ সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে যথাযথ পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।”

ফুসফুসের ক্যান্সার কি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব কিনা? এই প্রসঙ্গে ডা. চেতান বলেন, “ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য অস্ত্রোপচার বা সার্জারি অবশ্যই সম্ভব এবং ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে অবশ্যই নিরাময়যোগ্য। ধূমপায়ীদের ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই তাদের ক্যান্সারের অবস্থা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা যথাযথ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। আবার কখনও কখনও এন্ডোব্রোনকিয়াল বা ট্র্যাকিয়াল টিউমার ডেবালকিংয়ের মতো উপসর্গগুলো নিরাময়ের জন্যও অস্ত্রোপচার করা হয়ে থাকে।”

ফরেইন বডি কি? ফুসফুস থেকে এটি কিভাবে অপসারণ করা হয়? এই প্রসঙ্গে ডা. চেতান বলেন, “সহজভাবে বলতে গেলে ফরেইন বডি হলো এমন কোন জিনিস যা অনাকাক্সিক্ষতভাবে শরীরে প্রবেশ করে জটিলতা সৃষ্টি করে। ফুসফুসের ক্ষেত্রে ট্র্যাকিওব্রনকিয়াল ফরেইন বডি অ্যাস্পিরেশন একটি ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতা যার ফলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কারণ এটি শ্বাসনালীতে আটকে যায়, রোগীর অক্সিজেন চলাচল বাধা দেয় ফলে রোগী নিশ্বাস নিতে পারে না।

শিশুদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে। বিভিন্ন খাদ্যবীজ জাতীয় খাবার যেমন; বাদাম, বুট, ফলের বিচি, পপকর্ন ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষতভাবে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে (সাধারণত গিলে ফেলার কারণে) যেকোন দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এছাড়া শক্ত কোন বস্তু বা খেলনার কোন ক্ষুদ্র অংশও এই তালিকার বাইরে নয়। একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে পয়সা, বোতাম, মার্বেল ইত্যাদি গিলে ফেলার ঘটনাও ঘটে। এগুলো শ্বাসনালীতে আটকে গিয়ে শ্বাসচলাচল বন্ধ করে দিতে পারে যার ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

তবে মধ্যবয়স্ক বা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো ভিন্ন। পেরেক, পিন, দাঁতের কোন অংশ বা সম্পূর্ণ দাঁত গিলে ফেলা, সেফটি পিন বা হিজাবের পিন গিলে ফেলা (মেয়েদের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি বিষয় গুলো ফরেইন বডি হিসেবে ফুসফুসে জটিলতা সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, খাবার থেকেও এমনটা ঘটতে পারে। যেমন; খাবার ভালোভাবে না চিবিয়ে আস্ত গিলে ফেলা, মাংসের হাড়, মাছের কাঁটা, ফলের বিচি, চুইংগাম ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষতভাবে গিলে ফেলার কারণেও বিপত্তি ঘটতে পারে।

এমতাবস্থায় সময় নষ্ট না করে নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। সাধারণত ট্র্যাচিওস্টমি টিউব ডিভাইস ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে শ্বাসনালীতে আটকে থাকা পদার্থ পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা শ্রেয়।”

হাইপক্সিয়া সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা কম। ডা. চেতান বলেন, “হাইপোক্সিয়া খুবই পরিচিত একটি জটিলতা। হাইপোক্সিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীর বা শরীরের কোন একটি অংশে অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। তবে ব্যক্তিভেদে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যেতে পারে। ত্বকের রঙ পরিবর্তন, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, কাশি, হৃদ-কম্পন দ্রুত হয়ে যাওয়া, জোরে জোরে নিশ্বাস নেওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হাইপোক্সিয়া’র সাধারণ কিছু উপসর্গ। এসব উপসর্গ দেখা গেলে রোগীর জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”

অ্যাজমা বা হাঁপানি অতি সাধারণ একটি রোগ। অনেকেই মনে করেন এটি দুরারোগ্য একটি রোগ এবং সম্পূর্ণভাবে এর নিরাময় সম্ভব নয়। এই ধারণার সত্যতা সম্পর্কে ডা. চেতান বলেন, “হাঁপানি অবশ্যই একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ তবে নিয়ন্ত্রণযোগ্যও বটে। কারো শ্বাসকষ্ট আছে মানেই যে তার অ্যাজমা আছে, তা কিন্তু নয়। অ্যাজমা নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। অ্যাজমা আক্রান্ত রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ সেবন ও ইনহেলার ব্যবহারের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তবে অনিয়ন্ত্রিত অ্যাজমার জন্য কিছু আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিও রয়েছে। যেমন; ওমালিজুমাব, মেপোলিজুমাব, বেনরালিজুমাব ইত্যাদি। এছাড়া আমরা ব্রোনকিয়াল থার্মোপ্লাস্টি নামক একটি ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতির ব্যবহার করি। যা মূলত গুরুতর রোগীদের জন্য একটি এন্ডোব্রোনকিয়াল চিকিৎসা। অ্যাজমার ফলে ফুসফুসের পেশীগুলো সংকুচিত হয় তাই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ফুসফুসের পেশীগুলোতে মৃদু তাপ প্রয়োগ করা হয়। এতে করে শ্বাসচলাচল পুনরায় স্বাভাবিক হয়।”

যাদের ইতোমধ্যে ফুসফুস জনিত সমস্যা রয়েছে করোনাকালে তারা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? সাম্প্রতিক সময়ে সকলের মনেই এই প্রশ্নটি জাগে। ডা. চেতান নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, “যারা ইতোমধ্যেই ফুসফুস জনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় কম বা বেশি নয়। এমন কোনো তথ্য জানা যায়নি, যাতে করে এই বিষয়ে সঠিক মন্তব্য করা সম্ভব। করোনা এমন একটি ভাইরাস যা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে যে কারোই হতে পারে। আমরা এমন অনেক রোগীই পেয়েছি যারা একইসাথে ফুসফুস জনিত সমস্যা এবং করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও এসকল রোগীদের চিকিৎসার অধিকাংশ ফলাফলই নেতিবাচক। তবে এদের এবং সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় কোন পার্থক্য নেই।”

উপমহাদেশে ফুসফুস জনিত চিকিৎসার জন্য অসংখ্য হাসপাতাল রয়েছে। তাহলে রোগীরা কেন ইয়াশোদা-কেই বেছে নিবে? জটিল এই প্রশ্নের সহজ উত্তর দিয়ে তিনি বলেন, “মাল্টি-স্পেশালিটি সেন্টার হওয়ায় ইয়াশোদা হাসপাতাল-এ রয়েছে সর্বাধুনিক চিকিৎসা-সরঞ্জাম, ইন্টারভেনশনাল পালমোনোলজি সেট-আপ, গুরুতর রোগীদের জন্য এয়ার ট্রান্সফার সুবিধা, ইসিএমও এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবার ব্যবস্থা। এছাড়া আমাদের রয়েছে সর্বাধুনিক অ্যাজমা ক্লিনিক, আইএলডি (ইন্টারস্টিশিয়াল ফুসফুসের রোগ) ক্লিনিক। পাশাপাশি ফুসফুস এবং হার্ট-ফুসফুস চিকিৎসায় আমরা অসংখ্য সফলতা অর্জন করেছি। আমাদের রয়েছে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মী ও চিকিৎসকবৃন্দ যারা সর্বদাই রোগীদের সেবাদানে প্রস্তুত।”

প্রতি বছর অসংখ্য বাংলাদেশী সুচিকিৎসার জন্য ভারতীয় হাসপাতালগুলোতে পাড়ি জমান। ইয়াশোদাতেও এর ব্যতিক্রম হয় না। মূলত কোন ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশীরা সেখানে যান? এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা এন্ডোব্রনকিয়াল আল্ট্রাসাউন্ড দ্বারা এফএনএসি-সমূহ, মেডিকেল থোরাকোস্কোপি, সকল প্রকার উন্নত ব্রনকোস্কোপিক পদ্ধতি, এফবি অপসারণ, টিউমার ডিবালকিং, এয়ারওয়ে স্টেন্টিং, ব্রনকিয়াল থার্মোপ্লাস্টি ইত্যাদি চিকিৎসা করে থাকি। এবং প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশী রোগীরা এই চিকিৎসাগুলো নিতে আসে।”

করোনা চিকিৎসার অভিজ্ঞতা, সফলতা এবং কেমন হবে আমাদের করোনাময় ভবিষ্যত? ইত্যাদি প্রশ্নের জবাবে ডা. চেতান রাও বলেন, “ইয়াশোদা হাসপাতাল হায়দ্রাবাদ-এ সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সম্পন্ন হয়েছে। আমরা সকল এআরডিএস (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম) প্রোটোকল মেনে চিকিৎসা প্রদান করি এবং অনেক সাফলতাও অর্জন করেছি। আমরা গুরুতর করোনা এআরডিএস আক্রান্তদের ক্ষেত্রে একমো পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। ফুসফুস প্রতিস্থাপনের জন্য আমাদের রয়েছে একটি নিবেদিত এবং অভিজ্ঞ দল। যে সকল রোগীরা করোনা থেকে সেড়ে ওঠার পরও ফুসফুস জনিত জটিলতায় ভুগছিল, আমরা সফলভাবে তাদের ফুসফুস প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছি। সবশেষে বলবো, করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই এখনো থেমে যায়নি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো লড়ে যাবো এবং সকলকে একটি সুস্থ জীবন উপহার দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের ভবিষ্যত কেমন হবে তা আন্দাজ করা কঠিন, তবে সকলের উচিৎ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন আপোষ না করা। কারণ ভ্যাকসিনই আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবে।”


ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন