‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি/ মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা’। কবির চমৎকার উপলব্ধি। কবিদের হৃদয়ের দৃষ্টির মতোই শরৎকালে সবকিছুই মানুষের চোখে ধরা দেয় নতুন ভাবে। উপরে নীল আকাশ, ঘনকালো মেঘের ভেলা, সাদা কাশবন, অবারিত সবুজ মাঠ, মাঠের চতুর্দিকে সবুজের প্রাচীরসদৃশ দূরের গ্রাম যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে ‘আয় রে তোরা আয়’। মনের অজান্তেই কে যেন বলে উঠে ‘চল যাই চল যাই/ মাঠে ঘাটে নদীর প্রান্তরে/ যেদিকে চোখ যায় চলো যাই হারিয়ে’। কবিদের মতোই সাধারণ মানুষকেও শরতের শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া আর কাশফুল যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে; আয়রে তোরা আয়। ইট-পাথরের দালানকোঠার জঞ্জালের রাজধানী ঢাকা শহর থেকে কোনো নদী তীরে, গ্রামের বনবাদারে ছুটে গেলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা কি প্রশান্তি! আমরা ইট পাথরের এই মহানগরে যেন আটকে পড়ে গেছি। তাছাড়া শহরে রাজনীতি নামের কাদা ছোঁড়াছুড়ি, শঠতা, পাপ পংকিলতায় জীবন ত্যাক্ত বিরক্ত।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। পৃথিবীর আর ১০টি দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বছরে ৬ ঋতু। প্রকৃতি এই ঋতুগুলোতে সাজে নিজস্ব ঢংয়ে। শরৎকাল প্রতিবছর যেন বাংলা ভাষার কবিদের কবিতা লেখার ‘কাচা মশলা’ যোগান নিয়ে হাজির হয়। তাইতো জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা/ শেফালি ফুল ঝরেপড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা’। বিশ্বকবি রবীদ্রনাথ ঠাকুর তার শরৎ কবিতায় শরৎকে রূপায়ণ করেছেন ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা/ নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/ এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো নির্মল নীলপথে’। এমনকি শরতের সৌন্দর্য দেখে কবি আল মাহমুদও নীরব থাকতে পারেননি। ঋতুরানী শরতের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ কবি আল মাহমুদ লিখেছেনÑ ‘বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে শরতের উদারতা, মেঘ ভেসে যায় মাথার ওপরে বৃষ্টির ছোঁয়া দিয়ে, ইচ্ছা হয় না ঘরের ভেতর বসে থাকি সারা দিন, কিন্তু বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা টান লাগে সারা বুকে, মনে হয় যেন আমার বক্ষে কান পেতে আছে কেউ, আজ সারা দিন হাওয়ার মাতম বইছে বাঁধন ছিঁড়ে’।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতির খেলায় দুই মাস পর পরই হয়ে থাকে ঋতুর পরিবর্তন হয়। এই ঋতু পরিবর্তনে এখন বইছে শরৎকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন এ দুই মাস শরতের যৌবন। ভাদ্রের পর এখন আশ্বিন বিভিন্ন উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে গোটা বিশ্ব নাস্তানাবুদ। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার জনজীবন। কিন্তু আপন গতিতে চলছে ঋতু। শরতে প্রকৃতি ফুলে ফুলে সেজে ওঠেছে। কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ, উদার প্রকৃতির খেলায় মাঝেমধ্যে কোথাও কোথাও ক্ষণিক বৃষ্টিপাত হয়। তারপর রোদ বৃষ্টির কানামাছি খেলা। নদী, বিল, পুকুর ও হাওরের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলার পাগল করা হাসি প্রেয়সীর হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনপ্রাণ ভরিয়ে দেয়। শিশিরভেজা শিউলি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। অথচ আমরা শরতের প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়ে কংক্রিটের রাজধানীতে হাপিত্যেস করছি। হায়রে শহুরে জীবন!
নদীমার্তৃক বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, শীতলক্ষা, আড়িয়াল খাঁ, করতোয়া হাজারো নদীর তীর আর চরাঞ্চলের থোকা থোকা কাশফুল জানিয়ে দিয়েছে শরৎ চলছে। প্রতিদিন বিকালে নীল আকাশের নিচে বাতাসে দোল খাচ্ছে শুভ্র কাশফুল। প্রকৃতির পালা বদলের এই শরতের খেলা নগর-মহানগরে বসবাসরত মানুষ খুব মিস করছেন। তবে যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, বাংলার সৌন্দর্যকে হৃদয়ে ধারণ করেন, তারা ঠিকই দু’চার দিনের জন্য বেড়িয়ে পড়ছেন রাজধানী ছেড়ে নদ-নদীর তীরে, বনবনান্তরে।
কংক্রিটের রাজধানী ঢাকা থেকে বের হয়ে যে কোনো পথে কয়েক কিলোমিটার পেরুলেই চোখে পড়ে যায় শরৎ-প্রকৃতির মোহনীয় রূপ। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি, নদীর ধারে, গ্রামের কোনো প্রান্তে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া শুভ্র কাশফুলের স্নিগ্ধতা, রৌদ্রছায়ার খেলাÑ এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। পথের পাশের বিল ও ঝিলের পানিতে শাপলা শালুক ফুলের সুন্দর মায়াবী দৃশ্যের সমারোহ মনকে উদাস করে দেয়। তাই শরৎ বাংলা ভাষার কবিদের মন উদাস করে দেয়।
শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার রাত্রি ভালোলাগা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। শরতকালে ভোরে কুয়াশা পড়ে। শরতের সকালে কুয়াশা মাড়িয়ে খালি পায়ে চলতে কার না ভালো লাগে? সে এক আনন্দময় সুখকর স্মৃতি। সেই সাথে কুয়াশার উপরে যখন সকালের সূর্যের সোনালি আলো এসে পড়ে তখন শিশির বিন্দু মুক্তার দানার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সেই দৃশ্য আরও চমৎকার। দখিনের সমীরণ খুলে শরতের নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো সবার কণ্ঠকেই সুরময় করে তুলে। এই তো সময় মন আমার হারিয়ে যাওয়ার। চলো হারিয়ে যাই। তাইতো রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে/ বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে/ মালতীলতার বনে,- কদমের তলে/ নিঝুম ঘুমের ঘাটে, কেয়াফুল, শেফালীর দলে/ যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে/ হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরোঝরো/ কামিনীর ব্যথার শিয়রে/ যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে/ আর্ত কোলাহলে’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন