প্রতারণার অভিযোগে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল ও তার স্ত্রী (চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল ছিল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিন। তবে রিমান্ডে তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ সময় তিনি নানা কৌশলে প্রতারণার বিষয়টি বার বার এড়িয়ে যাচ্ছেন। রাসেল দাবি, তিনি কোনো টাকা আত্মসাৎ করেননি, প্রতারণার প্রশ্নই ওঠে না। গ্রাহক জেনেবুঝেই ইভ্যালিতে পণ্য অর্ডার করেছে, যারা ডেলিভারি পায়নি ভবিষ্যতে টাকা পেয়ে যাবে। এখানে প্রতারণার কোনো বিষয় ছিল না। শুধু তাই নয়, রিমান্ডে চঞ্চল্যকর কিছু তথ্যও দিয়েছেন তারা। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে ওইসব তথ্যের ভিত্তিতে ইভ্যালির কার্যক্রম নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিকসূত্র এমন তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে, গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাসেলসহ ইভ্যালির ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। গত শনিবার দিবাগত রাতে মো. কামরুল ইসলাম চকদার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
গতকাল ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী মিয়া বলেন, শনিবার দিবাগত রাতে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ইভ্যালির সিইও এবং চেয়ারম্যানকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছেন, ইভ্যালির ধানমন্ডি কার্যালয়ে তিনি ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহ করেছেন। কিন্তু ইভ্যালি তার পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। ওসি আরও জানিয়েছেন, কামরুল ইসলামের দায়ের করা মামলায় দুইজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মামলায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
মামলায় এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ছাড়াও আসামি করা হয়েছে- ইভ্যালির ভাইস প্রেসিডেন্ট আকাশ, ম্যানেজার জাহেদুল ইসলাম হেময়, সিনিয়র অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার তানভীর আলম, সিনিয়র এক্সিকিউটিইভ কমার্শিয়াল জাওয়াদুল হক চৌধুরী, হেড অব অ্যাকাউন্টস সেলিম রেজা, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার জুবায়ের আল মাহমুদ, অ্যাকাউন্টস শাখার কর্মকর্তা সোহেল, আকিবুর রহমান তূর্য, সিইও রাসেলের পিএস মো. রেজওয়ান, বাইক ডিপার্টমেন্টের সাকিব রহমানসহ অজ্ঞাত ১৫/২০ জন।
অপরদিকে তদন্ত সূত্র জানায়, রিমান্ডে রাসেল দাবি করেছেন, ইভ্যালির প্রতিটি পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পণ্য ডেলিভারির বিষয়ে শর্ত দেওয়া ছিল। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল স্টক থাকা পর্যন্ত। অনেক সময় স্টক শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারেননি। যাদের পণ্য ডেলিভারি দিতে পারেননি তাদেরকে টাকা রিফান্ড করেছেন। অনেকের রিফান্ড প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এছাড়াও প্রতিশ্রুত পণ্য সময়মত না দেওয়ার আরেক কারণ হিসেবে রাসেল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি নির্দেশনা দিয়েছে, কোনো গ্রাহক পণ্য অর্ডার করলে তাকে ওই পণ্যের ১০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাকি ৯০ শতাংশ টাকা গ্রাহক পণ্য পাওয়ার পর প্রদান করবেন। আমরা অনেকের কাছ থেকে অর্ডার নিয়েছি, সাপ্লাইয়ারকে অর্ডারের বিষয়ে জানিয়েছি। বেশ কয়েকজন সাপ্লাইয়ার ইভ্যালিকে ফুল পেমেন্ট ছাড়া পণ্য দিতে চায়নি। তাই ডেলিভারিগুলো আটকে গেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজন সেলার বলেছেন করোনাকালীন সময়ে অনেক পণ্যের উৎপাদন বন্ধ ছিল, তাই তারা ইভ্যালিকে পণ্য দেয়নি। ফলে গ্রাহকদেরকে সব পণ্য ডেলিভারি দেওয়া যায়নি।
গ্রাহকদের টাকা আটকানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে রাসেলের দাবি, জুলাই থেকে এ পর্যন্ত মোট তিন লাখ অর্ডার ডেলিভারি করেছে ইভ্যালি। যাদেরকে পণ্য দেয়া যায়নি তাদের টাকা রিফান্ড করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা (১০% অ্যাডভান্স) এবং ইভ্যালিতে কেনাকাটায় একের পর এক ব্যাংক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ইভ্যালির নগদ জমার পরিমাণ কমতে থাকে। ফলে রিফান্ড প্রক্রিয়ার গতি ধীর হয়ে যায়।
পুলিশ জানায়, ক্রেতা ছাড়াও ইভ্যালির কাছ থেকে অনেক বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠান মোটা অংকের টাকা পায়। গত তিন দিনে পুলিশের কাছে কমপক্ষে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা তাদের পাওনার বিষয়ে জানিয়েছেন। ক্রেতাদের মতো বিক্রেতারাও পাওনা নিয়ে শঙ্কিত। শিগগিরই পুলিশ সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওনার হিসাব লিখিত আকারে জমা নেবে।
তদন্ত সূত্র জানায়, ইভ্যালির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপারেশনাল পদে রাসেলের স্ত্রী (চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিনের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শামীমার বোনের স্বামী মামুনুর রশীদ, মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান শামীমার বোন সাবরিনা নাসরিন, পরিচালক শামীমার বন্ধু আতিকুর রহমান। এছাড়াও শামীমার দুই ভাগ্নে জাহেদ ও জুবায়ের মোটরসাইকেল বিক্রি সংক্রান্ত ডেলিভারির বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতেন। তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। ইভ্যালির অফিসে অভিযান পরিচালনা করেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি যাচাই-বাছাই করেছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গুলশান থানার এসআই ওহিদুল ইসলাম বলেন, আত্মসাৎ ও প্রতারণা নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। আমরা তদন্তের মাধ্যমে বের করার চেষ্টা করছি যে রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন কি না। তিনি বলেন, প্রাথমিক বিচার বিশ্লেষণ করেই একটা মামলা হয়। এখন অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে আমরা আত্মসাতের বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি। আর টাকাগুলো যদি আত্মসাৎ করা হয়, তাহলে সেই টাকা এখন কোথায় আছে তা জানার চেষ্টা করছি। তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত জানানো হবে।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট ইভ্যালির কার্যক্রম নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। ওই বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এতদিন ইভ্যালির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত করায় আমরা তদন্ত করিনি। তবে আমরা ইভ্যালির অর্থ পাচারের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। অর্থ পাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। এখনও পর্যন্ত ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
ওই ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাসেল ও ইভ্যালির ব্যাংক একাউন্টগুলো বেশ কিছু সময় জব্দ করা হয়েছিল। এই সুযোগে তিনি হুন্ডি করে টাকা পাচার করেছেন কি না সে-বিষয়েও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সুমন ও আব্দুল মান্নান নামে মতিঝিলের দুজন ডলার ব্যবসায়ীর সঙ্গে রাসেলের যোগাযোগ ছিল বলে জানা গেছে। তাদের মাধ্যমে রাসেলের টাকা হুন্ডির কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না এ বিষয়ে ওই দুই ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
রাসেলের মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর: রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করেছে গ্রাহকরা। গতকাল বিকেলে ধানমন্ডির ১৪ নম্বর সড়কের ইভ্যালির প্রধান কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচির আহ্বায়ক মীর আমজাদ হোসেন আকাশ বলেন, আমরা চাই প্রধান নির্বাহী আমাদের মাঝে ফিরে আসুক এবং গ্রাহকদের পাওনা মিটিয়ে দিক। তাকে গ্রেফতার করে আটকে রাখা কোনো সমাধান নয়। আমরা চাই গ্রাহক ও সেলাররা তাদের প্রাপ্য ফিরে পাক।
উল্লেখ্য, গত ১৬ সেপ্টেম্বর ভোরে আরিফ বাকের নামে এক ব্যক্তি রাসেল ও শামীমার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা করেন। পণ্যের জন্য আগাম অর্থ দিয়ে তা না পাওয়ার পাশাপাশি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ করা হয় মামলায়। মামলার বাদী আরিফ বাকের তার অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি ৩ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তাকে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। ওই মামলা হওয়ার পর ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে র্যাব। রাতে র্যাব সদরদফতরে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরদিন হস্তান্তর করা হয় গুলশান থানায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন