বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

অকাস চুক্তি ফ্রান্সকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৬:৫৪ পিএম

ফ্রান্সের কাছ থেকে এক ডজন সাবমেরিন কেনা নিয়ে পাঁচ বছর আগে করা একটি চুক্তিকে হঠাৎ পায়ে দলে অস্ট্রেলিয়া যে কায়দায় আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সাথে ‘অকাস’ চুক্তি করেছে, তাতে পশ্চিমা বিশ্বের মৈত্রী, ঐক্য এবং আস্থা সমূলে নাড়া খেয়েছে। ক্ষুব্ধ এবং অপমানিত ফ্রান্স ক্যানবেরা এবং ওয়াশিংটন থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছে, আর সোমবারের জন্য নির্ধারিত ব্রিটেনের সাথে একটি প্রতিরক্ষা সংলাপ তারা বাতিল করে দিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর ফ্রান্স কী করবে? অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার পথে কি তারা যাবে? যদি সে পথেই হাঁটতে চায় তারা, সেক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন হলো, সেই ক্ষমতাই বা তাদের কতটুকু রয়েছে? প্যারিসে বিবিসির সংবাদদাতা হিউ শোফিল্ড বলছেন যে, বিড়ম্বনা এবং অপমানের প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার পর ফ্রান্সকে ভীষণ অপ্রিয় কঠোর কিছু প্রশ্নের জবাব হাতড়াতে হবে। প্রথমত, তিনি বলেন, ফরাসীদের হয়তো নতুন করে অনুধাবন করতে হবে যে ভূ-রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বেলায় আবেগের তেমন কোন জায়গা নেই।

অস্ট্রেলিয়ানদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হচ্ছে, চীনের কাছ থেকে নিরাপত্তার ঝুঁকির মাত্রা যেভাবে বেড়েছে, তাতে ফরাসী ডিজেল-চালিত সাবমেরিনে তাদের চলবে না, বরং আধুনিক পারমানবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন দিয়ে চীনকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে ফরাসীরা অস্ট্রেলিয়ার এই যুক্তি গ্রহণ করেনি। তাদের কথা, অস্ট্রেলিয়ার চাহিদা মতই ডিজেল চালিত সাবমেরিনের তৈরি নিয়ে তারা কাজ করছিল এবং অস্ট্রেলিয়া চাইলে পরমাণুশক্তি চালিত সাবমেরিন তারাও সরবরাহ করতে পারতো। ফ্রান্স বলছে, অস্ট্রেলিয়া সেই ইঙ্গিত কখনই তাদের দেয়নি।

আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটন যখন প্যারিসে আসেন, তখনও সাবমেরিন নিয়ে ভিন্ন কোন ইচ্ছার কথা তিনি জানাননি। তার আগে জুন মাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সফরেও তিনি ভিন্ন কোন ইঙ্গিত দেননি। ফ্রান্সের আরও ক্ষোভ যে ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হয়েও কিভাবে ব্রিটেন এবং বিশেষ করে আমেরিকা, পুরো বিষয়টি তাদের কাছ থেকে গোপন রেখেছে। লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটর লিখেছেন, শুধু অস্ত্র বিক্রির চুক্তি হারানো নিয়েই ফ্রান্স যে ক্ষুদ্ধ তা নয়, অকাস চুক্তি দেখিয়ে দিয়েছে যে, পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে আমেরিকা ফ্রান্সকে বিশ্বাস করে না।

সে কারণেই হয়তো ফরাসী পরারাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ ইভ ল্য দ্রিঁয়া অকাস চুক্তিকে ‘পিঠে ছুরি মারার’ সাথে তুলনা করেছেন। প্যারিসে বিবিসির হিউ শোফিল্ড আরও বলছেন যে, ফ্রান্সের জন্য আরেকটি ‘অপ্রিয় বাস্তবতা’ হলো অকাস চুক্তি প্রমাণ করছে ন্যাটো জোট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আর তেমন মাথাব্যাথা নেই, এবং মিত্র দেশগুলোর প্রতি আনুগত্যকে তারা পরোয়া করছে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ফরাসী নেতা চার্লস দ্য গলের চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ফরাসী রাজনীতিকরা - যাদের মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল্য ম্যাখোঁও রয়েছেন - স্বপ্ন দেখেন যে ফ্রান্স হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন একটি বিশ্ব শক্তি। দেশের পারমানবিক শক্তি এবং সামরিক শক্তির ওপর তাদের রয়েছে অগাধ আস্থা। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে মেনে নিয়েই ফ্রান্স চলছে।

কিন্তু, হিউ শোফিল্ড বলছেন, এখন প্যারিসের ক্ষমতার করিডোরে করিডোরে প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে – ‘প্রয়োজন কি আমেরিকার সাথে থাকার? তাদের সাথে থেকে আমাদের লাভ কী হচ্ছে?’ ‘এই ধাক্কা হঠাৎ আকাশ থেকে এসে পড়েছে,’ বিবিসিকে বলেন ফরাসী দৈনিক ল্য ফিগারোর পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক রেঁনো জিরার্ড। তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের (পশ্চিমা ইংরেজি ভাষাভাষী জাতি) জন্য ম্যাখোঁ অনেক কিছু করেছেন। আফগানিস্তানে আমেরিকানদের সাহায্য করেছেন। ব্রিটিশদের সাথে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ানদের সাথে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সবসময় তাদের বলেছেন দেখ আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা তোমাদের সত্যিকারের মিত্র।’

প্রশ্ন হচ্ছে ফ্রান্স এখন করবে কী? দ্য গল ১৯৬৬ সালে ন্যাটোতে ফ্রান্সের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছিলেন। ২০০৯ সালে নিকোলাস সারকোজি ক্ষমতায় এসে সেই সিদ্ধান্ত বদলান। তাহলে ইমানুয়েল্য ম্যাখোঁ কি এখন ন্যাটো জোটে ফ্রান্সের ভুমিকা পূনর্বিবেচনা করবেন? এখনও তার কোনো ইঙ্গিত নেই, কিন্তু একথা সত্যি যে দুই বছর আগে ম্যাখোঁই মন্তব্য করেছিলেন যে, ন্যাটো জোটের ‘মস্তিস্ক এখন মৃত’।

কিন্তু, হিউ শোফিল্ড বলছেন, ফ্রান্সের সামনে আরেকটি অপ্রিয় সত্য হলো, আন্তর্জাতিক যে উচ্চাভিলাষ তাদের রয়েছে তা পূরণের সুনির্দিষ্ট কোন পথ এখনও তাদের সামনে নেই। ‘গত সপ্তাহের ঘটনাবলীর যে শিক্ষা তা হলো, ভূরাজনৈতিক কৌশলগত বিষয়ে জোরালো তেমন কোন ভূমিকা রাখার মত শক্তি ফ্রান্স নয়। ফরাসী নৌবাহিনীতে এখন জাহাজের যে সংখ্যা, চীন প্রতি চার বছরে সেই সংখ্যার জাহাজ তাদের নৌবাহিনীতে যোগ করছে।’ আর সেই চাপেই হয়তো অস্ট্রেলিয়া উপায়ন্তর না দেখে ফ্রান্সের মত মাঝারি শক্তিধর দেশকে অবজ্ঞা করে বড় একটি পরাশক্তির হাত ধরার চেষ্টা করেছে।

ফ্রান্স হয়তো এখন আবারও আমেরিকার ওপর নির্ভরতার কথা ভুলে স্বতন্ত্র একটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা কৌশল হাতে নেয়ার কথা শুরু করবে। তারা বলবে, ইউরোপের সেই প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল অকাস চুক্তি প্রসঙ্গে দু'দিন আগে বলেছেন যে এই ঘটনা ইউরোপের জন্য একটি ‘সতর্ক সঙ্কেত।’ ইইউ প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন নতুন করে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা জোটের কথা বলেছেন।

ইউরোপীয় যে নিরাপত্তা বাহিনীর কথা বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, বাস্তবে তার কোন দেখা এখনও নেই। ফরাসী সাংবাদিক রেঁনো জিরার্ডের মতে, ইউরোপীয় যৌথবাহিনীর কথা ‘হাস্যকর’। তিনি বলেন, ‘আপাতত তারা হয়তো ইউরোপে একটি জোট তৈরির চেষ্টা করবে। বিংশ শতাব্দীর জটিল মনস্তত্ব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তারা জার্মানিকে রাজি করানোর চেষ্টা করবে। জার্মানিকে তারা বলবে, সত্যিকারের একটি শক্তিধর দেশের মত আচরণ করতে, ভূমিকা রাখতে।’ তবে সামরিক শক্তি অর্জনে কতদূর তারা এগুবে কিংবা ন্যাটোর বাইরে গিয়ে ইউরোপে একটি সামরিক জোট তৈরি করা - এসব বিষয় নিয়ে জার্মানি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোহাম্মাদ সাকিব হাসান হাবীব ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৯:৩২ পিএম says : 0
অকাস বনাম ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে কোল পিঠ অবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখেনা বিষয়টির সমন্বয় একটি বড় শক্তি অন্যথায় শক্তির অবক্ষয়।ইসরাইল বাস্তুহারা একটি দালাল জাতি-এরাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন