শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

সত্যিকার অর্থে ২০০৮ সাল থেকে দেশের সবকয়টা জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এক-এগারোর সরকারের সাথে দেশি-বিদেশি কুশীলবদের বিশেষ সমঝোতায় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল বলে পরবর্তীতে নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়। সে নির্বাচনে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট। দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হলেও আমাদের গণতন্ত্র মূলত দ্বি-দলীয় প্রভাব বলয়ে আটকে আছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশেও শত বছর ধরে গণতন্ত্র রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম দশকের শেষ প্রান্ত থেকে আমাদের গণতন্ত্র তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদলে নির্বাচনে এই দুই দল প্রাধান্য বিস্তার করলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হয়নি। ২০০৮ সালেই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেল। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২ শতাধিক আসনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলেও আওয়ামী জোটের সাথে ভোটের ব্যবধানের চেয়ে আসনের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ২৩০ আসনের বিপরীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের মাত্র ৩০ আসনে নেমে যাওয়ার ঘটনা ছিল সবার কাছেই অতি বিস্ময়কর। নির্বাচনের এমন ফলাফলের পর অপ্রস্তুত বিএনপিকে নানাভাবে হেনস্তা ও দুর্বল করার সর্বাত্মক প্রয়াস এখনো চলমান আছে। এরপর দেশে আরো দুইটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যতই দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচনের ফলাফল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের আস্থার সংকট ক্রমেই বেড়েছে। বিরোধীদলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে লাখ লাখ নেতাকর্মীকে হামলা-মামলায় জর্জরিত করার পরও জাতীয় নির্বাচনে বিরোধীদলের নেতারা নির্বাচনে অবাধ অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি, ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের ভূমিকাকে প্রবলভাবে সঙ্কুচিত করে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে একপ্রকার নির্বাসিত করা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় পাস করে দ্বিতীয়বার সরকার গঠণ করেছিল আওয়ামী লীগ। কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশগ্রহণ করলেও সাধারণ ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। রাতের অন্ধকারে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করার ঘটনা শেষ পর্যন্ত গোপন রাখা যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের এমনতরো ধারা পরবর্তী প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনেও দেখা গেছে।

প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংকটে দেশের মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। গণতন্ত্র ব্যাহত-বিপর্যস্ত হলে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো মূল্যই থাকে না। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাক্সক্ষার মধ্যেই দেশের সব মানুষের পূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ নিহিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আরোপিত পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দেশে অনেক রাজনীতি হলেও ইতিহাসের সে শিক্ষা থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। একাত্তুরের ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পরও দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছিল। শত্রæ বাহিনীর হাতে আটক বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্য কোনো ঘোষণা দেয়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু তার চারপাশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা সে সময় সঠিক ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন কিনা, রাজনৈতিকভাবে তা একটি অমিমাংসিত প্রশ্ন। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা, সামরিক বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পুলিশের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও লক্ষ্য যাই হোক না কেন, স্বাধীনতার পর দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে রাষ্ট্রপতির একদলীয় শাসনকে পিতার হাতে সন্তান হত্যার সাথে তুলনা করেছেন একজন গবেষক। আজকের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার নস্যাৎ হওয়ার ধারাবাহিক ঘটনাকেও একই রকম অভিধায় অভিসিক্ত করা যায়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ ও শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে আন্দোলন ও ক্ষমতার প্রভাবের সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখা যায়। স্বৈরাচারী সরকারের সাথে গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সফল হলেও নব্বই পরবর্তী সরকার ও বিরোধীদল জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের মধ্যকার সমঝোতামূলক ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারেনি। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ দেখতে চেয়েছিল। খÐিত অর্থে দুই দশক বা এক-এগারো সরকারের পরবর্তী সময়কে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রান্তিকাল বিবেচনা করা হলেও এই সংকট মূলত বাহাত্তুর পরবর্তী সময় থেকেই সম্প্রসারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমার মধ্য দিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখলেও, তার প্রত্যাশার সাথে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষার মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়েছিল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে তিনি সম্ভবত একটি রিকনসিলিয়েশন চেয়েছিলেন। সেই রিকনসিলিয়েশন এখন পর্যন্ত হয়নি বলেই এখনো দেশে স্বাধীনতার ঘোষণাসহ অনেক ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এখনো দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার রাজনৈতিক এজেন্ডা সক্রিয় রয়েছে। এভাবে কোনো জাতি সাম্য,শান্তি, সমৃদ্ধি, সুশাসন ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারে না।

সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও তিনজোটের রূপরেখায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে প্রথম অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থেকে বিএনপি সরকার গঠন করে। আমার মতে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সেই নির্বাচনেই প্রথম সত্যিকার অর্থে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার গণদাবী প্রথমে প্রত্যাখ্যান করে একটি একতরফা নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করেও দুই মাসের মধ্যে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পুনরায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার কারণেই ১৫ ফেব্রæয়ারির একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিল পাস করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গর্ভনর জেনারেল স্যার স্টিফেন নিনিয়ান সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে খালেদা জিয়া তার প্রতিশ্রæতি রক্ষা করে কেয়ারটেকার সরকারের বিল পাস করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পর জুন মাসের ১২ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আসন সংখ্যায় সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থেকে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনো সরকারই পরপর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় যাওয়ার মত মেজরিটি অর্জন করতে পারেনি। ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত¡াববধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে সরকারী দল বিএনপি ও বিরোধীদল আওয়ামী লীগের মতপার্থক্য ও অনমনীয় মনোভাব, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পিছুটান এবং লগি-বৈঠার আন্দোলনে রক্তাক্ত রাজপথ দেশে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার জন্ম দেয়, যা শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দীনের এক-এগারোর সরকার সৃষ্টি করেছে। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে অস্বাভাবিক ফলাফলের নির্বাচনের পর পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল সব মানুষের প্রত্যাশিত। সেই প্রত্যাশিত সমঝোতার উপরই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যত নির্ধারিত ছিল। দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ তো বটেই জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো এ ক্ষেত্রে একটি সমঝোতার প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন তার প্রতিনিধি হিসেবে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে ৩ বার ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে ২০টি বৈঠক করেও তিনি প্রধান দুই পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। তবে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের বাইরের সব দলের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার পর একতরফা নির্বাচনের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম হলে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফরে এসে হাসপাতালে ভর্তি জাতীয় পার্টি নেতা এইচএম এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করিয়ে ৫ জানুয়ারীর ভোটারবিহীন নির্বাচনের পথ সুগম করেন। এ ধাপে আমরা বলতে পারি, গণদাবী ও আন্তর্জাতিক আকাক্সক্ষার বিপরীতে বাংলাদেশে ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের পথ তৈরী করে সে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিল ভারত।

গ্রাম-বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘এক কান কাটা গেলে বনের পথে যায়, দুই কান কাটা গেলে মেলায় ঘুরে বেড়ায়’। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে কোনো রকম রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণদাবী উপেক্ষা করেই ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে পরপর তিনবার ক্ষমতাসীন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ প্রায় পৌনে তিন বছর অতিক্রম করেছে এবং সরকারিদলের পক্ষ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা শোনা গেলেও গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকার বা সরকারি দলের কোনো সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখ যাচ্ছে না। তাদের কেউ কেউ আগের নির্বাচনগুলোর সময় যে সুরে কথা বলেছিল, এখনো সেই সুরেই কথা বলতে শুরু করেছে। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের গণদাবির বিপক্ষে তারা বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই নির্বাচন হবে। এরপর বিশ্ববাসী এক অদ্ভুত রকমের নির্বাচন দেখেছে। গণতান্ত্রিক বা ত্রæটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ছিটকে বাংলাদেশ এখন হাইব্রিড রিজিমের তালিকায় ক্রমাবনতিশীল অবস্থানে রয়েছে। সেই ২০০৭ সালে ত্রæটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তালিকা থেকে হাইব্রিড রিজিমের তালিকায় ঢুকেছে গত একযুগে। এ ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। একের পর এক ভোটারবিহীন-দখলবাজির জাতীয় নির্বাচনের কারণে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রশ্নে অনাস্থা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সব মানুষের এমন অনাস্থা যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। মূলত জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখেই দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের এজেন্ডাগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হয়। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শুরু করে দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরিবেশ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা অসম্ভব।
গত বুধবার ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন হাইব্রিড রিজিমের মধ্যে রয়েছে। লোক দেখানো বা আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর থাকেনি। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক বিবৃতিতে গত ৫০ বছরেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোনো স্বস্তিকর পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি মর্মে চরম হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। গণতন্ত্র না থাকায় দেশে আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সম্পদের সুষম বন্টন এবং নাগরিক অধিকারের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়নি। যে প্রত্যাশা ও অঙ্গিকার সামনে রেখে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে দেশে গণতন্ত্রের বদলে কখনো সামরিক স্বৈরাচার কখনো হাইব্রিড রিজিমের দখলে থাকবে তা মেনে নেয়া যায় না। যে দলের নেতৃত্বে দেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরে পর্দাপণের সময়ে একযুগ ধরে সে দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার এমন শোচনীয় অবক্ষয় ও জনগণের আস্থার সংকট ক্ষমতাসীনদের জন্য অনেক বড় লজ্জার বিষয়। সব দলের দাবীর প্রেক্ষাপটে দেশে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর তা বাতিল করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে একতরফা ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনের ধারাবাহিক তৎপরতা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রাসঙ্গিক ও সামগ্রিক এজেন্ডা পূরণের উদ্যোগ নেয়া না হলে তা দেশকে আবারো সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার ইতিহাস আছে। নব্বই দশকের শুরু থেকে পরবর্তী ৩টি নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল উন্নয়নশীল বিশ্বের নির্বাচন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হয়ে উঠেছিল। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা ছাড়া ক্ষমতাসীন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন হওয়া অসম্ভব। ভোটারবিহীন নির্বাচনে ফাঁকামাঠে গোল দেয়ার নির্বাচন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা যায় না। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করলেও দেশে এখনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। বিগত সময়ের মত এবারো বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে জাতিসংঘ সহায়ক ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে গঠণমূলক ভূমিকার বদলে অতীতের মতই বাগাড়ম্বরতা শোনা যাচ্ছে। ‘পলিটিক্স ইজ আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’, তবে এ কম্প্রোমাইজের সময়সীমা অনির্দিষ্ট নয়। আমাদের সরকার এবং বিরোধীদলগুলোকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতেই হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mohammad Ayub Ali ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:৫৮ পিএম says : 0
সুন্দর লিখনি। ভালো লাগলো কিন্তু বাস্তবে হবে অশ্বডিম্ব। বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ দুটি জিনিসকে ভয় পায় একটি হলো নির্বাচন আরেকটি সেনাবাহিনী।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন