শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঋণে জর্জরিত কওমি মাদরাসা

হতদরিদ্র বহু শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বাড়ি ভাড়া ও বেতন দেয়া যাচ্ছে না

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে সারাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো ঋণে জর্জরিত। প্রায় দু’বছর লকডাউনের দরুণ অর্থাভাবে হাজার হাজার কওমি মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানা বন্ধ হয়ে যায়। গত ১২ আগস্ট থেকে সরকার মাদরাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। মাদরাসাগুলোর হিফজ বিভাগের অবুঝ শিশুরা ভোর রাতেই ঘুম থেকে উঠে মধুর কণ্ঠে পবিত্র কোরআন পাঠে মগ্ন। করোনা মহামারি থেকে পরিত্রাণের জন্য কওমি মাদরাসাগুলোতে চলে নিয়মিত দোয়া। ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ায় শুকরিয়া আদায় করে মাদরাসার সব হাজত পূরণের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য কামনা করে ইমাম, খতিব, মুফতি, শাইখুল হাদিস ও ছাত্র-ছাত্রীরা নামাজের পর রোনাজারি করছেন।

ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানা পুনরায় চালু করা হয়েছে। দীর্ঘদিন মাদরাসা বন্ধ থাকায় হতদরিদ্র অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। করোনা মহামারি সংক্রমণের দরুণ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কওমি মাদরাসাগুলো পূর্বের ন্যায় শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে আর্থিক সহায়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মকর্ম ও অর্থনীতিসহ গোটা মানবজীবন অচল হয়ে পড়েছিল। আলহামদু লিল্লাহ, এখন ধীরে ধীরে গোটা বিশ্ব স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে আসছে। বাংলাদেশে এখন করোনা প্রাদুর্ভাব অনেক কমে এসেছে। সে জন্য দেশের অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ও খোলা হয়েছে। দীর্ঘ এ স্থবিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা। এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের কওমি মাদরসাগুলো অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি কোন বেতন-ভাতা ও অনুদান না থাকায় দীর্ঘ দু’বছরের বন্ধকালে শিক্ষক-স্টাফদের বকেয়া বেতন, নির্মাণ খরচ, গ্যাস, বিদ্যুত বিল, ভাড়ার মাদরাসাগুলোর বকেয়া ভাড়ার চাপে এখন খোলার পর পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা মাদরাসাপড়ুয়া সন্তানদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে না পারায় চরম দুরবস্থায় পড়েছে কওমি মাদরাসাগুলো। করোনার কারণে দান-অনুদান না থাকায় অর্থ সঙ্কটে বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে হিমসিম খাচ্ছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। লকডাউনের কারণে এতদিন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। অনেক শিক্ষক-কর্মচারী মাসের পর মাস বেতন পাননি। বর্তমানে দীর্ঘদিন পর মাদরাসাগুলো খুলে দেয়া হলেও আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না মাদরাসাগুলো। কওমি মাদরাসা নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে চালু থাকলে দ্বীন প্রচার-প্রসারে কোনো বাধা থাকবে না বলেও উল্লেখ করেন মাদরাসার মুহতামিমরা। বর্তমানে দৈনন্দিন কার্যক্রম, এতিমখানা পরিচালনাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদরাসাগুলোকে। মানুষের সদকা ও দানের ওপর নির্ভরশীল দ্বীনি শিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠান করোনার বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম করছে। শহরের চেয়ে গ্রামের মাদরাসাগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। এতিম শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে মাদরাসার শিক্ষকরা পুনরায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে কওমি মাদরাসা ২০ হাজারের অধিক। এসব মাদরাসায় রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকা। সাধারণত এসব মাদরাসা পরিচালিত হয় সমাজের বিত্তবানদের বিভিন্ন দান-অনুদানের মাধ্যমে। আবার অনেক মাদরাসা পরিচালিত হয় ভাড়া বাড়িতে। ছেলেদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য গড়ে উঠেছে হাজারো মহিলা মাদরাসা। মহিলা মাদরাসাগুলোতে পর্দানশীন ছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অনেক ছাত্রী মাসিক বেতন পরিশোধ করতে পারছে না। তার পরেও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ নারীদের শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে সহযোগিতা করে তাদের বের করে দিচ্ছেন না। লকডাউনের পর এখন ভাড়ায় চালিত মাদরাসাগুলো টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা উপকরণ মাদরাসার পক্ষ থেকে দেয়া হয়ে থাকে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীস্থ জামিয়াতুল ইমামিল আ’যম আল ইসলামিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আমজাদ হোসাইন ইনকিলাবকে জানান, মুসলিমদের যাকাত বা দানের টাকায় কওমি মাদরাসাগুলো চলে। এখানে মূলত ধর্মীয় শিক্ষাই দেয়া হয়। এসব কওমি মাদরাসার ওপর নির্ভর করে দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলো। মসজিদ লাগোয়া ছোট ঘরে যে পঠনপাঠন চলে, তার ওপরই ভরসা রাখে গরিব মুসলিম পরিবার।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য আজও অমøান’। কানো প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি, সেখানে ধর্মাশ্রিত এ ব্যবস্থার আজো কোনো বিকল্প নেই। তার উপর বড় সুবিধা অন্ন সংস্থানের। যে গরিব অভিভাবক অতি কষ্টে দু;’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করেন, তাঁর ছেলে-মেয়ে আবাসিক কওমি মাদরাসায় গিয়ে পড়াশোনার সঙ্গে পেট ভরে খেতে পেলে সেটা বাড়তি পাওনা। অনেক অভিভাবক প্রজন্ম পরম্পরায় এ শিক্ষাব্যবস্থার শরিক। তাই নতুন প্রজন্মকেও পূর্বসূরিরা মাদরাসায় পাঠাতে পছন্দ করেন। আবার অনেকে সচেতনভাবেই চান, তাঁর সন্তান হাফেজ, মাওলানা, মুফতি, ইমাম বা মোয়াজ্জিন হয়ে উঠুক; পরম্পরায় বহমান ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকুক। ধর্মাশ্রিত শিক্ষার প্রতি ঝোঁক ঐতিহাসিকভাবে বিদ্যমান।

মুফতি আমজাদ হোসাইন বলেন, কওমি মাদরাসায় কোরআন-হাদিসের ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে আরবি ভাষার পাঠ দেয়া হয়। আরবি সাহিত্য পড়ানো হয় এসব আবাসিক মাদরাসায়। আগেও শুধু ধর্মশাস্ত্র পাঠের ওপর জোর দেয়া হতো। এখন পরিস্থিতি বদলেছে, বর্তমানে এসব মাদরাসায় বাংলা, ইংরেজি, গণিতও শেখানো হয়। এছাড়া বিশ্বায়নের পর ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্দু শেখারও ব্যবস্থা আছে। এখান থেকে পাশ করার পর ছাত্ররা ইসলাম ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেয়। কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া ছাত্ররা বেকার থাকেন না। মুফতি বলেন, করোনা মহামারির দীর্ঘ দিন পর মাদরাসা খুলে দেয়ায় ঋণের বোঝা নিয়েই ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। কয়েক লাখ টাকার ঋণের কারণে তার মাদরাসার দু’টি ফ্লোরের মধ্যে একটি ফ্লোর ছেড়ে দিয়েই মাদরাসা চালু রাখতে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। কওমি মাদরাসার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ধর্মীয় শিক্ষার অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত হবে না বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রাজধানীর পুরোনো ঢাকার বড় কাটারা জামেয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার মুহতামিত মুফতি সাইফুল ইসলাম মাদানী গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে বলেন, মানুষের জীবনে ঋণ একটা বড় সমস্যা। করোনা মহামারির কারণে কওমি মাদরাসাগুলো ঋণে জর্জরিত। সকাল-বিকেল পাওনাদারের মুখোমুখি হয়েই মাদরাসা চালু রাখতে হচ্ছে। বড় কাটারা মাদরাসায় ১৩শ’ ২০ জন ছাত্র এবং ৪৯ জন শিক্ষক রয়েছে। করোনা মহামারির দরুণ মাদরাসায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়মিত দান-অনুদান গত দু’বছর যাবৎ বন্ধ রয়েছে। জনগণের দান অনুদানের ওপর ভিত্তি করেই মাদরাসা চলে আসছে। ৮৩ জন এতিমসহ ৭৮০ জন ছাত্র মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে ফ্রি খানা খায়। এক প্রশ্নের জবাবে মুহতামিম মুফতি সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৪০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে গত ১২ আগস্ট থেকে মাদরাসা চালু করা হয়েছে। তার মতে, অধিকাংশ কওমি মাদরাসাগুলোই ঋণের ওপর ভর করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করছে। তিনি মাদরাসাগুলোর দৈন্যদশা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

নগরীর রামপুরার জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম নতুনবাগ মাদরাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস হাফেজ মাওলানা ড. গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, কওমি মাদরাসা চলে আল্লাহর বিশেষ দয়া ও করুণায়। আমরা রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে রোনাজারি করে দোয়া করি। এ উসিলায় আমাদের প্রয়োজনগুলো আল্লাহপাক পূরণ করে দেন। তিনি বলেন, করোনার কারণে জনসাধারণের কওমি মাদরাসার প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়েছে। আগে তাদের কাছে যেতে হতো। এখন তারা মাদরাসায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করছেন।

আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্বারী নাজমুল হাসান পরিচালিত যাত্রাবাড়িস্থ তাহফিজুল কোরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদরাসায় দীর্ঘ দিন পর হিফজ বিভাগ পুরোদমে চালু করা হয়েছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ করোনা মহামারি থেকে মুক্তি, দেশ জাতির উন্নতি সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যাণ কামনা করে প্রতিদিনই দোয়া করছেন বলে জানিয়েছেন।
সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়স্থ শাইখুল হিন্দ (রহ.) ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মুহতামিম মুফতি খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী জানান, মাদরাসার বিল্ডিং ভাড়া তিন মাস ও ১১ জন শিক্ষকের ৬ মাসের বেতন বাবদ প্রায় ৯ লাখ টাকা বাকি রেখেই গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে মাদরাসা চালু করা হয়েছে। মুফতি খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, অর্থ সঙ্কটের দরুণ অনেক কওমি মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে আদর্শ সুনাগরিক তৈরি হচ্ছে। দুর্দশাগ্রস্ত কওমি মাদরাসাগুলোতে সরকারি প্রণোদনা দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। দোলাইরপাড়স্থ জামিয়াতুল আনওয়ার ঢাকা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি কামাল উদ্দীন শিহাব কাসেমী ইনকিলাবকে বলেন, তার মাদরাসায় ১৬জন শিক্ষকের বকেয়া বেতন ও বাড়ি ভাড়াসহ ১৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েই মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে নতুন উদ্যোমে মাদরাসা চালু করেছি। করোনা মহামারির কারণে বাড়ির মালিক দু’মাসের ভাড়া মওকুফ করেছেন।

যশোর মনিরামপুর জামিয়া ইমদাদিয়া মাদানীনগর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা রশীদ বিন ওয়াক্কাস বলেন, করোনার কারণে বেশি সমস্যা হয়েছে গরিব শিক্ষার্থীদের। মাদরাসা ১৮ মাস বন্ধ থাকার কারণে থাকা খাওয়ার খুবই সমস্যা হয়েছে তাদের। অনেকে ঝরেও পড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২১শ’। আর আবাসিক ছাত্র-ছাত্রী তেরশ’। সবাই বোর্ডিং থেকে খাবার গ্রহণ করে। ৬শ’ ছাত্র-ছাত্রীর সম্পূর্ণ ফ্রি ভাবে লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ঢাকার মানিকনগর খাতুনে জান্নাত মহিলা মাদরাসার পরিচালক মুফতি আবুল হাসান শামসাবাদী বলেন, শতকরা ৯০ ভাগ মহিলা মাদরাসা ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে। এসব মাদরাসার আয়ের উৎস ছাত্রীদের টিউশন ফি। দীর্ঘ দিন ধরে এসব মহিলা ও প্রাইভেট মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে পরিচালকগণ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক বাড়ি ভাড়া জমে গেছে। শিক্ষকদের অনেক বেতন বকেয়া রয়ে গেছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি সরকারিভাবে বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করলে ভাল হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মধ্যপাড়া খাতুনে জান্নাত মহিলা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা সৈয়দ এহসানুল ইসলাম বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে অনেক বাড়ি ভাড়া জমে গেছে। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। বাড়িওয়ালা অনেক ভালো মানুষ। তিনি অর্ধেক ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষিকাদের বেতন অনেক বাকি। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর সহজ হবে।

যাত্রাবাড়ীস্থ মাদরাসাতুল কোরআন আল ইসলামিয়ার মুহতামিম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্বারী তাওহিদ বিন আলী লাহোরী ইনকিলাবকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে গেছে। গত জুলাই মাস থেকে মাদরাসার বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ১১ জন শিক্ষকের বেতন দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ক্বারী লাহোরী বলেন, আমি নিজেও জানি না আল্লাহপাক মাদরাসা চালাতে কিভাবে সাহায্য করছেন। আর্থিক সঙ্কটে পড়লে আমি দু’রাকাত নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। মহান আল্লাহ দু’বারই আমাকে টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। করোনা মহামারির প্রভাবে ত্রিশ-চল্লিশ জন ছাত্র ঝরে পড়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ঢাকার একটি কওমি মাদরাসার শিক্ষক মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী বলেন, মাদরাসার গরিব ও দরিদ্র ফান্ডে জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করেন। তবে শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয় সাধারণ ফান্ড থেকে। দীর্ঘদিন মাদরাসা বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিক্ষকের বেতন বাকি। তিনি সমাজের বিত্তবানদেরকে সাধারণ ফান্ডেও দানের আহ্বান জানান।

বগুড়ার আলেমে দ্বীন মাওলানা আব্দুল মতিন ইনকিলাবকে জানান, খাতুনে জান্নাত বালিকা মাদরাসা নামে তিনি একটি মাদরাসা পরিচালনা করেন। এই মাদরাসার দুটি ক্যাম্পাসে ছাত্রী সংখ্যা ৭ শতাধিক। এখানে হেফজ, মক্তব শাখা থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়ানো হয়। ৬০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা রয়েছেন তার মাদরাসায়। তার মাদরাসাটি পরিচালিত হয় ছাত্রীদের বেতনের টাকায়। দীর্ঘ দিন ছাত্রীদের বেতন আদায় স্থগিত থাকায় কষ্টে পড়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারিরা। শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন বকেয়া রেখেই মাদরাসা চালু করা হয়েছে।
তানজিমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া উত্তরবঙ্গ,-এর বগুড়া শাখার সভাপতি মাওলানা আব্দুস সবুর বলেন, বগুড়ার ৫ শতাধিক মাদরাসা দীর্ঘ দিন পর চালু হওয়ায় শুধু পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পড়ানোই বা হিফজ শাখার শিক্ষার্থীদের কোরআন মুখস্থই করা হয় না বরং করোনাসহ আসমানি ও জমিনি বালা মুসিবত থেকে হেফাজতের জন্য নিয়মিত দোয়া খায়েরও করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গ মাদরাসা বোর্ডের অফিস সহকারী মাওলানা মো. বশির জানান, উত্তরবঙ্গভিত্তিক তানজিমুল মাদারিসিত দ্বীনিয়া মাদরাসা বোর্ডের অধীনে মাদরাসার সংখ্যা ৩ হাজার। চরম আর্থিক সঙ্কটের মাঝেই কওমি মাদরাসাগুলোয় পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে জোরেশোরে।

বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা একেএম আশরাফুল হক বলেন, হাজার হাজার মাদরাসার শিক্ষক করোনাকালীন সময় বেতন-ভাতাছাড়া অতিবাহিত করেছেন। অনেকে কর্মচ্যুত হয়েছেন। এমন বিপর্যয় ও সঙ্কটের দরুণ প্রাথমিক স্তরের অনেক কওমি মাদরাসাই আজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কওমি মাদরাসাগুলো যদি টিকে থাকতে না পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো এই শিক্ষা ব্যবস্থাই হুমকির সম্মুখীন হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সরকার এই করোনাকালীনও বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়েছে। তাই বিশেষ বিবেচনায় ক্ষতিগ্রস্ত মাদরাসাগুলোকে প্রণোদনা প্রদানের দাবি করেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
সবুজ ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৩:১৬ এএম says : 0
সমার্থবান সকলের উচিত এসব প্রতিষ্ঠানের পাশে দাঁড়ানো
Total Reply(0)
salman ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৬:১২ এএম says : 0
Allah, toma'r Rohomot er Hat deyee ader Sahajjo Bariye daw.
Total Reply(0)
Munshi Rezowanul Islam ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৭ এএম says : 0
এতিমদের কষ্ট দেয়ার ফল হবে অনেক ভয়ংকর
Total Reply(0)
Shahin Sarkar ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৮ এএম says : 0
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হইলো।
Total Reply(0)
Nazera Zahir Chowdhury ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৯ এএম says : 0
This is Muslim majority country but picture is totally opposite.
Total Reply(0)
Zobayed Ahmed ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৯ এএম says : 0
আল্লাহগো এই এতিমদের হেফাজত করো। এদের কষ্টের কারণে আমাদের উপর গজব দিয়ো না। তোমার কুদরত দারা হেফাজত করো।
Total Reply(0)
Ibrahim ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৯:০০ এএম says : 0
আমরা যদি কমপক্ষে ৫/ টু ১০০/ টাকাও দেই তাহলে এই সমস্যা অনেক কেটে যাবে। মনে করি ৫০ জনে ৫/ করে দিলে ২৫০/ তাহলে ৮ জন ছাত্র একবেলা খেতে পারে। ভেবে দেখুন ৫/ দিয়ে আপনি একজনকে একবেলা খাওয়ালেন। যার প্রতিদান আল্লাহ আমাদের আখিরাতে ও দুনিয়াতে দিবেন। আসুন গোপনে আমরা যার যার অবস্থান থেকে দান করি। আল্লাহ আমাদের সহি বুঝ দান করুন। আর মনে রাখতে হবে মাদ্রাসার অন্যতম আয়ের উৎস চামড়া সে চামড়ার দাম অথচ জুতার দাম বেড়েই চলেছে। এটা সুদূর প্রসারী নীল নকশা ইসলাম বিরোধীদের
Total Reply(0)
Dadhack ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৪০ পিএম says : 0
........ তো এটাই চাই যে দেশ থেকে ইসলামকে উধাও করে দিলে তারা দেশ লুটেপুটে খেতে পারবে চিরজীবন
Total Reply(0)
আফজাল হুসাইন নাজিরপুরী ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:৩১ পিএম says : 0
অত্যান্ত সময় উপযোগী পোষ্ট। আমার হাজারীবাগ নূরুল কুরআন মাদ্রাসা ১৩ লাখ টাকা ঋণ । আমাদের কান্নাকরা ছাড়া আর কিবা করার আছে!
Total Reply(0)
Afzal Hossain ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৭:৩৮ পিএম says : 0
অত্যন্ত সময়োপযোগী পোস্ট, আমার মাদ্রাসা ঢাকা হাজারীবাগ নূরুল কোরআন মাদ্রাসা প্রায় 13 লাখ টাকা ঋণ। আমাদের আল্লাহর কাছে কান্না করা ছাড়া আর কিবা করার আছে?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন