শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মরহুম মাওলানা ছালিক আহমদ রহ.

মাহফুজ আল মাদানী | প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

চিরন্তন সত্য মৃত্যুকে কেউ কোনদিন অস্বীকার করেনি, বা উপেক্ষা করতে পারেনি। যারাই এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন চলে গিয়েছেন তাদের আপন ঠিকানায়। যারা জীবিত আছেন এবং যারা আসবেন তারাও একই পথের পথিক হবেন। মহান রবের অমীয় ঘোষণা, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মরণের স্বাদ ভোগ করবে’। এই নিরেট সত্যকে অমান্য করার কোন সুযোগ নেই। এরপরও কোন কোন মৃত্যু হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে, রক্তকরণ হয়, দুমড়ে মুচড়ে যায় অন্তর। মেনে নেয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। তেমনি এক মৃত্যুর সংবাদ শুনতে হয়েছিল গত ২৪শে জুন সূর্য উঠার সাথে সাথেই। আর তাইতো সেই ব্যক্তির জানাযায় বক্তব্য দিতে গিয়ে উনারই সহকর্মী মুহতারাম অধ্যক্ষ আবু জাফর মুহাম্মদ নুমান সাহেব বলেছিলেন, ‘আমরা কেউই আজ এমন সূর্যোদয়ের আশা করছিলাম না, এমন শোকাবহ সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’ বলছিলাম ইলমে দ্বীন চর্চার অন্যতম সূতিকাগার বাংলাদেশ তথা সিলেটের অন্যতম দ্বীনি দরসগাহ সৎপুর কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মরহুম হযরত মাওলানা ছালিক আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা।

যিনি ছিলেন একাধারে একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন দাঈ ইলাল্লাহ, একজন মিষ্টিভাষী আলোচক, একজন লেখক, একজন ইসলামী স্কলার, একজন ইলমে নববীর ধারক বাহক, একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব, তাফসিরকারক, মুহাদ্দিস, ফিকহবিদ, বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, আল্লাহওয়ালা, পরহেযগার, ইলমে তাসাউফের উচ্চমাপের বুজুর্গ, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অন্যতম অভিভাবক। ছিলেন আরো বহুবিদ গুণে গুণান্বিত। সেই মহান ব্যক্তি পশ্চিম সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজী ইউনিয়নের ভ‚রকী গ্রামে স্বাধীনতার তিন বছর আগে ১৯৬৮সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এলাকার স্বনামধন্য খ্যাতিমান পীর আবুল লেইছ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। মরহুম মাওলানা ছালিক আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন নম্র, ভদ্র ও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। যা তাঁর শিক্ষকগণের বক্তব্য থেকেই প্রস্ফুটিত হয়। গ্রামের পাশ্ববর্তী ইলমে দ্বীনের অন্যতম মারকাজ সৎপুর কামিল মাদরাসা থেকে ১৯৯০ সালে কামিলে প্রথম বিভাগ লাভ করে কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। তার আগে ১৯৮১ সালে যামানার মুজাদ্দিদ আল্লামা ফুলতলী ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন।

পড়ালেখা শেষ করেই ইলমে দ্বীন চর্চা ও প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্রথমে জকিগঞ্জ পরবর্তীতে ইছামতি কামিল মাদরাসায় দুবছর পর্যন্ত আরবী প্রভাষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। এরপর নিজের শিক্ষাকেন্দ্র সৎপুর কামিল মাদরাসায় আরবী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৩ সালে। সেখানে প্রথমে আরবী প্রভাষক পরে অধ্যাপক, মুহাদ্দিস এবং সর্বশেষ উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি দারুল ক্বিরাতের ভূরকী মাদরাসা শাখার প্রধান ক্বারী, নাযিমসহ ফুলতলী প্রধান কেন্দ্রের পরীক্ষক ও পরিদর্শক হিসেবে জীবনের শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

ক্ষণজন্মা এই মহান আলেম শুধু অধ্যাপনাই নয় ইসলাম প্রচারে সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ওয়াজ মাহফিল ও আলোচনার মাধ্যমে এক অভূতপূর্ণ সাড়া জাগিয়েছিলেন। দুনিয়াবিমুখ এই ইসলামী স্কলার তাঁর দরদমাখা সুমিষ্ট কন্ঠে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ইসলামের কথা বলতেন প্রাঞ্জল করে। যা শ্রোতাদের আকৃষ্ঠ করতো, মুগ্ধ করতো, মনে দাগ কাটতো, আমলের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করতো। যার আচার আচরণে, চাল চলনে, আমলে আখলাকে সুন্নতে নববীর পরিপূর্ণতা প্রকাশ পেতো। তিনি শুধু একজন মুহাদ্দিসই ছিলেন না, ছিলেন ইলমে তাফসীর ও ইলমে ফিকহের অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী। পাঠদানে ছিলো এক সম্মোহনী শক্তি। এই মহান ব্যক্তির কাছে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আমি অধমেরও হয়েছে। আমি আলিম জামাত থেকে কামিল পর্যন্ত উনার কাছ থেকে ইলমে দ্বীন শিখেছি। তিনি ছিলেন আমার অন্যতম অভিভাবক। প্রায়ই ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিতেন। পাঠদান করানোর সময় শিক্ষার্থীরা অপলক নয়নে তাঁর দিকে তাকিয়ে মনযোগ সহকারে নিরব হয়ে আলোচনা শুনতো। এমন শিক্ষক ও জ্ঞানী ব্যাক্তি সমাজে বিরল।

হাদীস শরীফের ভাষায়, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নেন না, কিন্তু দ্বীনের আলেমদের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে তা উঠিয়ে নিবেন।’ আর তার যথার্থতা এই রকম জ্ঞানী, পরহেযগার আলেম ওলামাগণের উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে।

এই ক্ষণজন্মা মরহুম হযরত মাওলানা ছালিক আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিগত ২৪শে জুন বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে সাত ঘঠিকায় সিলেটের একটি বেসরকারী হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাওলায়ে হাক্বীকির সান্নিধ্যে চলে যান। ইন্না লিল্লাাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইন্তেকালের সময় তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে, অসংখ্য আত্মীয় স্বজন, হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। আমরা মহান রবের কাছে এই মনীষির রুহের মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করছি। আমীন।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন