সভ্যতার গায়ে যত সময়ের ভাঁজ পড়ে সভ্যতা ততই আধুনিক হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জটিল থেকে জটিলতর হয় জীবন-সমস্যা। সেই সব সমাধানে ব্যস্ত আধুনিক মানুষ প্রায়ই ছোটোখাটো শারীরিক অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে গতির স্রোতে গা ভাসায়। তারপর এই উপেক্ষা, অবহেলাই একদিন ব্যুমেরাং হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে। যেমন অ্যাসিডিটির কথাই ধরুন না। দীর্ঘদীন ধরে নানা কাজের অজুহাতে তাকে লাগাতার অবহেলা করেছেন। ভেবেছেন, এটা আবার একটা সমস্যা নাকি! তারই নিট্ ফল, আলসার।
আলসার কী জানতে হলে চোখ ফেরাতে হবে আমাদের পাকস্থলীর দিকে। কারণ, আলসার নামের এই রোগটির মূল কারণ যে অ্যাসিডিটি তার উৎস হল পাকস্থলী। পাকস্থলীটি আমাদের পৌষ্টিকনালীর এমন একটি অংশ যেখানে বিভিন্ন জারক রসের উপস্থিতিতে খাদ্যের পরিপাক ক্রিয়া শুরু হয়। এই পাকস্থলীর গায়ে মিউকাস সেল, পেপটিক সেল এবং প্যারাটাইল বা অক্সিনটিক কোষ নামক তিন ধরণের কোষ থাকে, যা থেকে যথাক্রমে মিউকাস, পেপসিন ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ক্ষরিত হয়। পেপসিন নামক এনজাইমটি প্রোটিন ও ফ্যাটের পরিপাকে সাহায্য করে। এছাড়া গ্যাসটিক অ্যাসিডিটি খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবিষ্ট জীবাণু ধ্বংস করে, পেপসিনকে সক্রিয় করে এবং খাদ্যস্থিত লোহার শোষন ত্বরান্বিত করে। পাকস্থলী থেকে ক্ষরিত পাচক রসে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড থাকার জন্য তীব্র অম্লধর্মী হয় এবং সারাদিনে ক্ষরণের পরিমান প্রায় ২,০০০-৩,০০০ মিলিমিটার হয়। কোনও কারণে পাকস্থলীর পাচক রসের ক্ষরণ বেশি হতে থাকলে বা তীব্র অম্লধর্মী এই পাচক রস থেকে অন্ত্রকে রক্ষাকারী মিউকাস আবরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে কিংবা দীর্ঘক্ষণ অন্ত্রে খাবার না-থাকলে পাচক রস মিউকাস আবরণটিকে আক্রমণ করে ক্ষত সৃষ্টি করে। মিউকাসের এই ক্ষতিকে বলা হয় আলসার।
আলসার আমাদের পৌষ্টিক নালীর বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। ইসোফেগাসের নীচের দিকে হয় ইসোফেজিয়াল আলসার। গ্যাসট্রিক আলসার হল পাকস্থলীর মিউকাসের ক্ষত। ডিওডিনামের মিউকাস আবরণে ক্ষত সৃষ্টি হলে তাকে বলা হয় ডিওডিনামের আলসার। সাধারণভাবে এই তিন ধরণেরই আলসার দেখা যায়। তবে কখনও কখনও ব্যতিক্রম হিসাবে ক্ষুদ্রান্ত্রের নীচের দিকেও আলসার হতে পারে।
যে-কোনও আলসারের ক্ষেত্রেই রোগের কারণে আমাদের দেহে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে এই অসুবিধাগুলোই হল রোগ লক্ষণ, যা আপনাকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা ভাবতে বাধ্য করে।
* গলা, বুক জ্বালা করা,
* পেটে ব্যথা,
*গা বমি ভাব,
* মুখে পানি কাটা,
*ঢেকুর ওঠা,
* খাবারের অরুচি
* রক্তবমি,
* কালো রঙের মল ত্যাগ প্রভৃতি।
আলসার হওয়ার প্রধান কারণ হল পৌষ্টিকনালীতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিমাণ অ্যাসিড তথা পাকস্থলীর পাচক রসের উপস্থিতি। তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে দায়ী আমরা নিজেরাই। সমীক্ষায় দেখা গেছে আলসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পুরুষদের সংখ্যাধিক্য মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি। ডিওডিনাল আলসারের ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার অনুপাত ২:১ এবং গ্যাসট্রিক আলসারের ক্ষেত্রে এই অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৫:১। যদিও আলসারে পুরুষ আধিপত্যের কারণই আমাদের দেহে আলসারের প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে যেমন-
* এইচ পাইলোরি নামের এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া পাকস্থলীতে বসবাস করে অ্যাসিড ও পেপসিন ক্ষরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ১০-১২ বছর বয়সেই খাদ্য বা পানির সঙ্গে এই ব্যাকটেরিয়া সকলের অলক্ষ্যে দেহে প্রবেশ করে বাসা বাঁেধ। অবশ্য ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষের পাকস্থলী ব্যাকটেরিয়ার আশ্রয়স্থল হলেও সব ক্ষেত্রেই আলসার হয় এ কথা বলা যায় না। কিন্তু অধিকাংশ আলসারের কারণই এই এইচ-পাইলোরি। দেখা গেছে, পরিবারে আলসারের প্রবনতা থাকলে এই রোগের সম্ভবনা অন্যদের তুলনায় সামান্য বেশি।
*বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ব্যতীত যখন-তখন ব্যথা কমানোর ওষুধও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। কারণ বাজারে চলতি ওষুধগুলো অ্যাসিড ক্ষরণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়।
* খাওয়ার অনিয়ম। কারণ ক্ষরিত পাচকরস খাবারের উপরে কাঝ না-করতে পেরে খালি পৌষ্টিকনালীর মিউকাস আবরণকে আক্রমণ করে। * ধুমপান ও অ্যালকোহলের নেশা পাচরসক নির্গত হয়।
* অতিরিক্ত কাজের চাপ ও দুর্ভাবনার কারনে অতিরিক্ত পাচরসক নির্গত হয়।
* লিঙ্গভেদে কিছু হরমোনের পার্থক্য ও শারীরিক গঠনের পার্থক্যের জন্যও আলসারের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
আপনার দেহে আলসার রোগ লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ ঘটলে ভয় না-পেয়ে দ্রুত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। চিকিৎসার জন্য প্রথম প্রয়োজন রোগ নির্ণয়। সেই কারণে তাঁর পরামর্শ মতো বেরিয়ামমিল এক্স-রে, আপার জি আই এন্ডোস্কোপি প্রভৃতি পরীক্ষা করান। তারপর শুধু বিশেষজ্ঞের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শুধু ওষুধ খাওয়া, মাত্র ৭-১৪ দিন। ব্যস্, নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন।
আলসার থেকে নিজেকে বাঁচাতে কিছু কিছু নিয়ম মেনে চলুন। নয়তো আপনার সুস্থ শরীরকে আবারও সমস্যায় ফেলতে পারে এই আলসার।
* দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকবেন না। ৩-৪ ঘন্টা পর সামান্য হলেও খাবার খান। তবে কখনো অতিরিক্ত খাবার খেয়ে পেটের উপর চাপ ফেলবেন না। তাহলে হিতে-বিপরীত হতে পারে।
* অতিরিক্ত তেল, ঝাল, মশলার থেকে লোভ সংবরণ করুন।
* অ্যালকোহল ও ধূমপানের নেশা থাকলে স্বাস্থ্যের কারণে পরিত্যাগ করুন।
* বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া বাজার-চলতি যে-কোনও ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়া বন্ধ করুন।
* কাজের চাপ ও টেনশন থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব মুক্ত রাখুন।
* রাত্রে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুমটুকু পুরো ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
* বিশেষজ্ঞের মতামত মেনে নিয়ম মতো চিকিৎসা করান।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন