শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

প্রকৃত বন্ধু ও মুখোশধারী বন্ধু

চীনের টিকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ভারত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার চালান আটকে দেয়ায় জীবনমরণ সঙ্কটে পড়ে দেশের জনগণ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

‘বিপদে বন্ধুর পরিচয়’ এবং ‘সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়/অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়’। গ্রামীণ এই প্রবাদ দুটির মাধ্যমে ‘প্রকৃত বন্ধু’ আর ‘মুখোশধারী বন্ধু’ স্বরূপ চিত্রায়িত হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে টিকা ইস্যুতে পৃথিবীর দেশে দেশে ‘প্রকৃত বন্ধু’ ও ‘মুখোশধারী বন্ধু’ মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের করোনার টিকা দেয়া নিয়ে ভারত ও চীন দুই দেশের মধ্যে কারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু তারই প্রকাশ পেয়েছে। ৩ কোটি টিকার দাম অগ্রিম নিয়েও সেরামের বাংলাদেশমুখী টিকার চালান বন্ধ করে দিয়েছে ভারতের মোদি সরকার। অথচ বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে যাতে টিকার আওতায় আনা যায় সে লক্ষ্যে চীন উদারভাবে টিকা পাঠাচ্ছে ঢাকায়।

অদৃশ্য ভাইরাস করোনার টিকা নিয়ে গোটাবিশ্বে কার্যত ‘অদৃশ্য যুদ্ধ’ শুরু হয়। কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কারের আগেই ধনী দেশগুলো সম্ভাব্য উৎপাদিত টিকার প্রায় ৯০ ভাগ অগ্রিম কিনে নেয়। এতে বিপদে পড়ে যায় অন্যান্য দুর্বল দেশগুলো। এ অবস্থায় রাশিয়া, ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ লগ্নিতে টিকা আবিষ্কার ও উৎপাদন শুরু হয়। অতপর পৃথিবীর দেশে দেশে শুরু হয় ‘টিকা বাণিজ্য’। কিন্তু ‘রক্তের সম্পর্কের’ বন্ধুত্বের দাবিদার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ৩ কোটি ডোজের অগ্রিম টাকা নিয়েও সময়মতো টিকা দেয়নি বাংলাদেশকে। ক্রয়কৃত টিকার ৫০ লাখ ডোজ দেয়ার পর বাংলাদেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনাভাইরাসের গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হয়। আড়াই মাস ধরে টিকাদান চলার পর ভারতের মোদি সরকার সেরামের টিকা বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় ২৫ এপ্রিল সরকার প্রথম ডোজ টিকাদান বন্ধের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। দুই মাস সাত দিন বন্ধ থাকে। এ সময় কার্যত মরণঘাতী সঙ্কটে পড়ে বাংলাদেশ। লাখ লাখ মানুষ টিকা নেয়ার জন্য মুখিয়ে অথচ টিকা দিতে পারছেন না সরকার। বিশেষজ্ঞরা বার বার টিকা দেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। পরে অবশ্য চীন থেকে টিকা এনে পয়লা জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে আবারও গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়।

অথচ দেশের কিছু দিল্লিমুখী আমলার চীনের প্রতি বিদ্বেষের পরও দেশটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপুল পরিমাণ টিকা সরবরাহ করে। একদিনে ভারতের টাকা নিয়ে নির্ধারিত সময়ে টিকা না দেয়ার প্রতারণা; অন্যদিকে চীন উপযাজক হয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘উপহার’ এবং টিকা বিক্রি করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু কে, চীন না ভারত?

বর্তমানে ধনী দেশগুলো টিকা কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন করায় টিকার চাহিদা কমে গেছে। অনেক দেশ টিকার তৃতীয় ডোজ তথা বুষ্টার টিকা দেয়া হয়ে গেছে। এখন জাপান, রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভ্যাক্সের মাধ্যমে গরিব দেশগুলোকে বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে। আবার তারা পছন্দের দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে টিকা বিক্রি করছে। ফলে বিশ্ববাজারে করোনার পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা রয়ে গেছে। বাংলাদেশের ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে করোনা টিকার আওতায় আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতেকরে ২৪ থেকে ২৫ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য এখন এই টিকা ক্রয় কোনো ব্যাপারই নয়। ফলে বাংলাদেশের দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন, ‘টিকার জন্য সেরামকে দেয়া অগ্রিম টাকা ফেরত নেয়া হবে’। তাছাড়া ভারতেও টিকার চাহিদা কমে এসেছে। এ অবস্থায় ভারত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার কথা প্রচার করছে।
এদিকে বিশ্বের দেশে দেশে করোনা টিকা বিষয়ক তথ্য ঘেটে দেখা যায়, টিকা দেয়া এবং টিকা বিক্রিতে চীনের অবস্থান সবার উপরে। চীন নিজ দেশের প্রায় দেড়শ কোটি জনগণকে টিকার আওতায় আনার পরও দক্ষিণ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমাণ টিকা সরবরাহ করেছে। ওই সব দেশে চীনের টিকা নেয়ায় পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চীনের টিকা বুষ্টার ডোজ হিসেবে দেয়া হচ্ছে। চীন বাংলাদেশেও বাণিজ্যিক টিকা সরবরাহ নির্ধারিত সময়ের আগেই করছে।

চীন থেকে টিকা পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে কার্যত টিকা নিয়ে সঙ্কট কার্যত কেটে গেছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ৩ কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশের বেক্সিমকোর চুক্তি করে। অতঃপর ভারত ২১ জানুয়ারি উপহার হিসেবে ২০ লাখ ডোজ সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়। ২৫ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির প্রথম চালানের ৫০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসে। ২২ ফেব্রুয়ারি সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ঢাকায় পৌঁছে। ২৬ মার্চ ঢাকায় আসে ভারতীয় উপহারের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ডোজ টিকা। ৮ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে ঢাকা সফরের সময় এক লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে আসেন। সব মিলে ভারত থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এক কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসে। এর মধ্যে সেরামের কাছে টাকা দিয়ে তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসেছে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার কথা ছিল।

অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে চীন সরকার ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারকে ৫ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয়ার প্রস্তাব সম্বলিত একটি চিঠি দেয়। চিঠি দেয়ার তিন মাস পর কোনো উত্তর না পেয়ে মে মাসে ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিক্যাব) এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং জানান, বাংলাদেশকে ৫ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয়ার জন্য চীন যোগাযোগ করেছিল চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি। চিঠির জবাব দিতে বাংলাদেশ সরকার সময় নিয়েছে প্রায় ৩ মাস। এ খবর প্রচার হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য দেশ থেকে টিকা ক্রয়ের চেষ্টার পাশাপাশি চীন থেকে টিকা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে ১২ মে চীন বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে প্রথম দফায় ৫ লাখ সিনোফার্মের টিকা দেয়। ১৩ জুন চীন থেকে সিনোফার্মের ৬ লাখ উপহারের টিকার দ্বিতীয় চালান ঢাকায় আসে। ৩ জুলাই চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ১১ লাখ ডোজ করোনা টিকা ঢাকায় পৌঁছে। ৩ জুলাই দ্বিতীয় ধাপে চীনের সিনোফার্ম থেকে কেনা ৯ লাখ টিকা দেশে পৌঁছায়। চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের ১০ লাখ ডোজ ১৭ জুলাই ঢাকায় আসে। অতপর ১৮ জুলাই সিনোফার্মের টিকা ১০ লাখ ডোজ ঢাকায় আসে। অতঃপর আগস্ট মাসে দুই দফায় সিনোফার্ম থেকে বাংলাদেশ সরকারের কেনা ৭০ লাখ ডোজ এবং ৫৬ লাখ ডোজ টিকা এসেছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর সিনোফার্ম থেকে দেশে আসে ৫৪ লাখ ১ হাজার ৩৫০ ডোজ টিকা। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর ৫০ লাখ ডোজ ও ২৩ সেপ্টেম্বর আসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা। অর্থাৎ চীন থেকে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকা এসেছে ৩ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ১৫১ ডোজ।

এছাড়াও ৩১ মে দেশে এসে পৌঁছায় টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা ফাইজার বায়োএনটেক এর এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা। ২ জুলাই কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার ১৩ লাখ করোনার টিকা আসে। ৩ জুলাই কোভ্যাক্সের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপহার মডার্নার সাড়ে ১২ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসে। গতকাল হোয়াইট হাউজ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় আগামী কাল সোমবার ২৫ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দেয়া হবে।

এ ছাড়াও কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় জাপান ৩০ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেয়। এই ৩০ লাখ ডোজ টিকা এক বিমানেই বাংলাদেশে পাঠানো যেত। অথচ জাপান ৫ দফায় এই টিকাগুলো বাংলাদেশে পাঠায়। যারা টিকা কূটনীতি নিয়ে কাজ করছেন তাদের ভাষায় জাপান কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তার চেয়ে প্রচারণা বেশি করে নাম কামানোর কৌশল করেছিল। তবে দেশের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নিয়ে বিশ্বে যে খেলা হচ্ছে তাতে আগামীতে দেশে দেশে কূটনীতির ধারাই পাল্টে যাবে। প্রতিবেশী বা শক্তিমান দেশ হিসেবে নয়; বরং দুর্দিনে যারা পাশে থাকবে তাদের বন্ধু হিসেবে নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
সফিক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৩:০৫ এএম says : 3
আমাদের নীতিনির্ধারনী মহল কবে যে আসল বন্ধু চিনবে, সেটাই দেখার বিষয়
Total Reply(0)
Zahidul Islam ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৩ এএম says : 2
বড় বড় পদে হিন্দুদের বসানোর ফলেও কেন ভারত থেকে টিকা এলোনা।আর ভারতে ইলিশ যাচ্ছে কেন।
Total Reply(0)
Murad Seven ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৩ এএম says : 3
চিন আমাদের আসল বন্ধু ।
Total Reply(0)
Reehan Rehman ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৬ এএম says : 0
টিকার জন‌্য টাকা দেওয়া তো একটা নাটক ছি‌লো ,, আমা‌দের কে সেই নাটক দে‌খি‌য়ে টিকা আর ই‌ন্ডিয়া‌কে মাধ‌্যম ক‌রে তারা নি‌জে‌দের জন‌্য বিশাল একটা এমাউন্ট গা‌য়েব ক‌রে দি‌য়ে‌ছে আর কিছুই না !
Total Reply(0)
Šhîpøň Mâhmûď ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৬ এএম says : 2
টিকা বদলে তো এম্বুলেন্স দিছেই,,,,,প্রতারণা করলো কোথায়
Total Reply(0)
Rafiqul Islam Ripon ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৭ এএম says : 0
এটা বুঝাই আমাদের জন্য বড় ৷
Total Reply(0)
Titu Chowdhury ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৮:২৭ এএম says : 3
অভাবের তারনায় প্রতারনা। ভারত হলো বিশ্ব চিটার যতো দিন বিশ্বাস করবে ততো দিন অভাবের তাড়নায় প্রতারনা করবে।
Total Reply(0)
কামরুল ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১১:৩৯ এএম says : 0
আমরাই তো ইন্ডিয়ার কাছে বিয়ে বইসা গিয়াছি
Total Reply(0)
আতিকুর রহমান ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ২:০৯ পিএম says : 0
প্রকৃত বন্ধু কে? ভেবে দেখার সময় এসেছে।
Total Reply(0)
osman ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ২:৫২ পিএম says : 3
Thanks you সাহসী সাংবাদিক চালিয়ে যান ♥♥♥ সাবধানে থাকবেন ভাই ♥♥♥
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন