শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

নারায়ণগঞ্জে বহুরূপী অপরাধী চক্রের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার

নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৬:৫১ পিএম

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ অটো রিকসা, ইজিবাইক চোর, ছিনতাইকারী, অপহরণকারী ও সংঘবদ্ধ খুনি চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও নিলফামারী থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের একজনের কাছ থেকে একটি সুইচ গিয়ার চাকু উদ্ধার করা হয়। এবং ৫টি চোরাই অটো রিকসা গ্যাজের সন্ধান পেয়েছে। বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে লিংক রোডের ভুইগড়ে পিবিআইয়ের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানানো হয়।

পিবিআই নারায়ণগঞ্জ ইউনিটের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, গত ৬ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার নরসিংহপুর কাউয়াপাড়াস্থ জাহাঙ্গীরের গ্যারেজ থেকে প্রতিদিনের মতো ব্যাটারি চালিত মিশুক নিয়ে বের হয় আব্দুল কুদ্দুস। কিন্তু রাতে সে বাসায় না ফেরায় এবং বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করে তার সন্ধান না পেয়ে তার স্ত্রী রীনা খাতুন ১৮ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা মডেল থানায় জিডি করেন। থানা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই জিডি নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা থাকায় পিবিআইয়ের সহায়তায় রীনা খাতুন অপহরণ মামলা দায়ের করে। পিবিআই স্ব-উদ্যোগে মামলটির তদন্তভার গ্রহণ করে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত একে একে ৬জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো-শাহ আলম (৩৮), পিতা-মৃত আঃ সালাম, সাং-চৌরার বাড়ী, ধামগড়, বন্দর, নারায়নগঞ্জ, বর্তমানের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল, হালিম (৪২) পিতা-মৃত নুরুল ইসলাম, সাং-আমতলী, গৌরিচন্না, বরগুনা, মোঃ শহিদুল (৩২) পিতা-আঃ খালেক সাং- জোলাগাতি, কাউখালী, পিরোজপুর, বাদশা (৪৭) পিতা-মৃত আঃ রব, সাং-বউ ঠাকুরানী, বরগুনা, বর্তমানে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী, মোঃ আসলাম (৩০), পিতা-মোঃ সালাম মিয়া, সাং- হাতুরাপাড়া ৮নং ওয়ার্ড, সোনারগাঁ, মোঃ মনির (৪০) পিতা-মৃত আলী আকবর, সাং- পেঁচাইন ৩ নং ওয়ার্ড, সোনারগাঁ।

নারয়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও আড়াইহাজার, নীলফামারীর ডিমলা এবং ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় আসামী শাহ আলমের কাছ থেকে ভিকটিম আঃ কুদ্দুসের মোবাইল এবং ছিনতাই কাজে ব্যবহার করা একটি ডাবল ডেগার (সুইচ গিয়ার চাকু) জব্দ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা তাদের অটোরিক্সা-ইজিবাইক ছিনতাইয়ের অভিনব কৌশলের কথা স্বীকার করে। তাদের ভাষ্যমতে, তারা মূলত ৮/১০ জনের একটি গ্রুপ নারায়নগঞ্জ সহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় অটোরিক্সা-ইজিবাইক, অটো মিশুক ছিনতাই করে। এবং ৩টি পদ্ধতিতে তারা তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে।

পদ্ধতি-১: সাহেব-দারোয়ান অভিনয় করে অটো চুরি, এই পদ্ধতিতে চক্রের একজন সদস্য শহরের যে কোন একটি বাসার সামনে বাসার কেয়ারটেকার/দারোয়ান হিসেবে দাড়িয়ে থাকবে এবং একটি রিক্সা ডেকে আনবে। ওই সময় চক্রের আরেকজন সদস্য বাড়ীর মালিক হিসেবে দারোয়ানের সামনে আসবে এবং দারোয়ানের সাথে কুশল বিনিময় করবে (যেমন- গ্যাস বিল দেয়া হয়েছে কী না, পানি ওঠানো হয়েছে কী না, গাড়ী কোথায়, গেট খোলা কেন ইত্যাদি)। দারোয়ান এবং বাড়ীর মালিক অভিনয় করে ভিকটিম রিক্সাচালকের মনে চক্রের একজনকে দারোয়ান এবং অপরজনকে বাড়ীর মালিক হিসেবে বিশ্বাস সৃষ্টি করাই মূল লক্ষ্য থাকে। অতঃপর বাড়ীর মালিকের অভিনয় করা চক্রের সদস্য দারোয়ানের সাথে কথা শেষ করে রিক্সায় ওঠে এবং গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর রিক্সায় ওঠা চক্রের সদস্যের মোবাইলে কল আসবে এবং সে মিথ্যা অভিনয়ে কথা বলবে। কথা বলার একপর্যায়ে সে রিক্সা থামাবে এবং টার্গেট ভিকটিম রিক্সাওয়ালাকে তার দারোয়ানকে দ্রুত ডেকে আনার জন্য বলবে। রিক্সাওয়ালা ওই যাত্রীকে বাড়ীর মালিক ভেবে রিক্সা রেখে দারোয়ানকে ডাকতে গেলে ওই স্থানেই পূর্ব থেকে দাড়িয়ে থাকা চক্রের অপর ড্রাইভার সদস্য রিক্সাসহ বাড়ীর মালিকবেশী যাত্রী নিয়ে চলে যায় এবং ওই দিকে ভিকটিম রিক্সাওয়ালা দারোয়ানকে খুঁজতে গেলে দারোয়ান আগেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরবর্তীতে তারা রিক্সাটি তাদের নির্দিষ্ট চোরাই গ্যারেজে বিক্রি করে দেয়।

পদ্ধতি-২: নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে অটো ছিনতাই, এই পদ্ধতিতে তারা যে অটোরিক্সাটি টার্গেট করে সে অটোরিক্সাটিকে চোর চক্রের একজন দারোয়ান সেজে অটোরিক্সাটি ডাকে, একজন কোট-টাই পরিহিত সাহেব হিসেবে অটোরিক্সার যাত্রী সাজে, অন্য আরও দুইজন সাহেবের বন্ধু হিসেবে অটোরিক্সায় উঠে চালকের চাহিদামত ভাড়ায় রাজি হয়ে চক্রের পূর্বপরিকল্পিত স্থানে যেতে বলে। পথিমধ্যে তারা সুবিধাজনক স্থানে নেমে ড্রাইভারের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য ড্রাইভারকে চা খাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ওই সময় তারা সু-কৌশলে ড্রাইভারের চায়ের মধ্যে চেতনানাশক/ উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। চা খাওয়ার পর তারা আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে ড্রাইভার আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়লে ছিনতাইকারী চক্রের পূর্বনির্ধারিত প্রশিক্ষিত ড্রাইভার গাড়ীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তারা তাদের সুবিধাজনক নির্জন স্থানে গিয়ে চক্রের সদস্য কোট-টাই পরিহিত সাহেব ভিকটিম ড্রাইভারকে নিয়ে নেমে যায় এবং চক্রের ড্রাইভার সদস্য সহযোগী সদস্যকে নিয়ে গাড়ীটি তাদের পূর্বনির্ধারিত চক্রের অপর সদস্য চোরাই গাড়ীর ক্রেতার কাছে নিয়ে গাড়ীটি বিক্রি করে দেয়। এরপর চোরাই গাড়ীর ক্রেতা গাড়ীটিকে যাতে মুল মালিক সনাক্ত করতে না পারে সেজন্য তাদের নির্ধারিত গ্যারেজে নিয়ে গাড়ীটির রং-পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে অধিক দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

পদ্ধতি-৩: অপহরণ/খুন করে অটো ছিনতাই, এই পদ্ধতিতে তারা পদ্ধতি-১ এর মত কৌশল করেই অটোরিক্সা ভাড়া করে তাদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে যাওয়ার চেষ্টাকালে কখনো যদি ওই ড্রাইভার ছিনতাই চক্রের কৌশল বুঝে ফেলে কিংবা কোন সন্দেহ তৈরি হয় তখন ওই ড্রাইভার তাদেরকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে ছিনতাই চক্রের সদস্যগন প্রথমে উক্ত ড্রাইভারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অটো ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে গাড়ীর ড্রাইভার ছিনতাই চক্রকে গাড়ীটি ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তাৎক্ষনিক তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে মৃত অথবা অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে দিয়ে গাড়ীটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

সূত্রে বর্ণিত মামলাটি তদন্তকালে আসামীদেরকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আসামীরা তাদের অটোরিক্সা-ইজিবাইক ছিনতাইয়ের অভিনব কৌশলের কথা জানায়। তারা জানায় অত্র মামলার ভিকটিম আব্দুল কুদ্দুসের ক্ষেত্রে তারা তাদের পদ্ধতি-১ অবলম্বন করে ঘটনার দিন ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা অনুমান ৭ টায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ছিনতাই চক্রের সদস্য আসামী শাহ আলম, হালিম এবং রাশেদ ওরফে রিয়ন ভিকটিম মিশুক চালক আঃ কুদ্দুসকে সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড স্ট্যান্ড থেকে ৫০০ টাকা ভাড়ায় কালীবাজারে আপ-ডাউন যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পথিমধ্যে তারা আদমজী এলাকায় ভিকটিম ড্রাইভারকে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত চায়ের দোকানে নিয়ে চা খেয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। তারা নারায়ণগঞ্জ সদরের টানবাজারে গিয়ে ৩০০ টাকায় আধা লিটার মদ কিনে। মদ কেনার পর তারা খানপুর হাসপাতালের আশপাশের স্থানে গিয়ে নিজেরা মদ খায় এবং ড্রাইভার কুদ্দুসকে মদ খাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে মদ খেতে রাজি হলে কৌশলে আসামী শাহ আলম মদের মধ্যে উচ্চমাত্রার ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়। ঔষধ মেশানো মদ খাইয়ে আব্দুল কুদ্দুসসহ তারা আবার চিটাগাং রোডের দিকে যাত্রা শুরু করে। মদ খাওয়ার ২০-২৫ মিনিট পরে আস্তে আস্তে আব্দুল কুদ্দুস অচেতন হয়ে পড়লে আসামী শাহ আলম ড্রাইভারকে নিয়ে আদমজী এলাকার বিহারী পট্টিতে নেমে পড়ে এবং আব্দুল কুদ্দুসকে বিহারী পট্টিতে ময়লার ভাগারের পাশে রেখে চলে যায়। চক্রের অপর ড্রাইভার সদস্য হালিম এবং তার সহযোগী আসামী রাশেদ ওরফে রিয়নকে নিয়ে তাদের পূর্বনির্ধারিত চোরাই গাড়ীর ক্রেতা আসামী আসলামের কাছে গাড়ীটি ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। আসামী আসলাম গাড়ীটির রং, সীট কভার এবং হুড চক্রের অপর সদস্য আসামী মনিরের মাধ্যমে পরিবর্তন করে ফেলে। উক্ত ছিনতাই চক্রের সকল আসামীদের গ্রেপ্তার করার পর তাদের দেয়া তথ্যমতে ছিনতাই হওয়া মিশুক অটো রিক্সাটি আসামী আসলাম এবং মনিরের যৌথ গ্যারেজের পেছন থেকে উদ্ধার করা হয়

জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে যে, তারা প্রায় ৩ বছর যাবৎ অনুমান ২৫০ এর বেশী ইজিবাইক এবং অটোরিক্সা ছিনতাই করেছে। তদন্তকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় আরো ৫টি চোরাই গ্যারেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই গ্যারেজগুলোতে অতিদ্রুতই অভিযান পরিচালনা করা হবে।

তিনি আরও বলেন, মামলার ভিকটিম উদ্ধারসহ এই চক্রের আরও কোন সদস্য জড়িত আছে কী না তা তদন্ত অব্যাহত আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন