বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দালালদের নিয়ন্ত্রণেই পাসপোর্ট অফিস! আগারগাঁওয়ে ভুক্তভোগীদের অবস্থান

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

বিদেশ যাত্রী কিবরিয়া হোসাইন। তিনি গত বছর আগস্ট মাসে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। দালাল ছাড়াই আবেদন করে মহাবিপদে পড়েন তিনি। বিভিন্ন জটিলা দেখিয়ে প্রায় ৮ মাস পরে পাসপোর্টটি হাতে পান তিনি। কিন্তু সময়মত পাসপোর্ট না পাওয়ায় এখনো বিদেশ যাওয়া হয়নি কিবরিয়ার। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবেকে এমন তথ্য জানিয়েছেন কিবরিয়া। শুধু কিবরিয়া নয়, পাসপোর্টের আবেদন করে তার মতো অনেকেই ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। তবে ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টের আবেদন করেন। এতে বাড়তি টাকা লাগলেও সময় মত পাসপোর্ট ডেলিভারি করা হয়। ভুক্তভোগীদের সাথে আলাপ করে এমন তথ্যই জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে দালালের দৌরাত্ম্য কমছে না। বিভিন্ন সময় র‌্যাবের অভিযানে দালালেরা ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে আগের কাজই করছেন। শুধু তাই নয়, দালাল ছাড়া যদি আবেদন জমা দেয়া হয় তা হলে; সার্ভার নষ্ট, অফিসার আসেননি, ছবিতে সমস্যা, জন্ম তারিখ ভুল এমন হাজারও সমস্যা তুলে মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় পাসপোর্ট ডেলিভারি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দেশের প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে তৈরি হয় পাসপোর্ট। বাইরে থেকে দালালরা নিয়ন্ত্রণ করে পাসপোর্ট অফিসগুলো। দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে পড়তে হয় হয়রানিতে।

সূত্রমতে, প্রায় প্রতিদিনই একটি নির্দিস্ট সময়ে দালালের মাধ্যমে ঘুসের ফাইল জমা নেওয়া হয়। সাধারণত বেলা ৩টার পর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের ৫০১ নম্বর কক্ষে অবৈধ এ কার্যক্রম চলে। দালালের কাছ থেকে আদায় করা ঘুসের টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হয় সন্ধ্যার পর। এজন্য অফিস সময়ের পরও কর্মকর্তাদের অনেকে অফিসেই বসে থাকেন। লেনদেন বুঝে নিয়ে কেউ কেউ বাসার উদ্দেশে গাড়িতে ওঠেন রাত ৮টার পর।

সূত্র আরো জানায়, আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগ আবেদন জমা হয় ঘুস চ্যানেলে। আবেদনপ্রতি নূনতম ঘুস নেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। এ হিসাবে দৈনিক ঘুসের পরিমাণ দাঁড়ায় নিদেনপক্ষে ১০ লাখ টাকা। মাসে আসে প্রায় ৩ কোটি টাকা।
শুধু ঢাকার পাসপোর্ট অফিস নয়, দেশের ৬৪টি জেলার পাসপোর্ট অফিসেই আছে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য। ঘুস না দিলে পদে পদে হয়রানি আর চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। নানাবিধ উদ্যোগ সত্তেও পাসপোর্ট সেবা অনেকটাই যেন আটকে গেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, চাঁদপুর, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চাঁন্দগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য এখন চরমে।

এদিকে, পাসপোর্টে দালাল চক্রের হাত থেকে মুক্তি, ভুল সংশোধন ও নানা জটিলতা নিরসনের দাবিতে গতকাল সকালে রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে অবস্থান দেন ভুক্তভোগীরা। অবস্থান কর্মসূচিতে তারা পাসপোর্টের সবধরনের ভোগান্তি নিরসনের দাবি জানান। বিকেল ৩টার দিকেও তাদের অবস্থান নিতে দেখা যায়।
ভুক্তভোগীরা জানান, অবস্থান নেওয়া প্রত্যেকেরই পাসপোর্টের সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ড কিংবা সার্টিফিকেটের নাম ও বয়সের পার্থক্য রয়েছে। এসব সংশোধনের জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই তারা পাসপোর্ট অফিসে ঘোরাঘুরি করেও কোনো সমাধান পাননি।

রাসেল নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমরা কোনো উপায় না পেয়ে গতকাল রোববার সকাল থেকে অবস্থান নিয়েছি। দুপুরে আমাদের মধ্য থেকে চারজনের একটি প্রতিনিধি দল মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে যায়। কিন্তু মহাপরিচালককে না পেয়ে আমরা সহকারী পরিচালকের সঙ্গে কথা বলি। সহকারী পরিচালক আমাদের সমস্যা সমাধানের কোনো আশ্বাস দেননি।

সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে মিলন, দিন ইসলাম, ইব্রাহিম ও খলিল বলেন, আমরা যখন সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করি, তখন তিনি আমাদের সার্বিকভাবে কোনো সমস্যা সমাধানের আশ্বাস না দিয়ে বরং আমাদের চারজনকেই সংশোধনের প্রস্তাব দেন।
এ ব্যাপারে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সহকারী মহাপরিচালক রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, যারা এসেছেন তারা প্রত্যেকেই বয়স পরিবর্তনের জন্য এসেছেন। কারও কারও ভোটার আইডি ও সার্টিফিকেটের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত। কিন্তু সরকার থেকে আমাদের যে পরিপত্র দেয়া হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত পরিবর্তন করা সম্ভব। এখন তারা দাবি জানালেও আমাদের কিছু করার নেই।

বয়স পরিবর্তন করতে হলে কী করতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেন, তারপর মন্ত্রণালয় যদি বিষয়টা আমলে নেয়, তবেই সেটা সম্ভব। যেসব ভুক্তভোগী এসেছিলেন তাদের নির্দিষ্ট কয়েক জনকেই সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানাবেন পাসপোর্ট সংশোধনপ্রতাশী ভুক্তভোগীরা। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ একটি দালালচক্র অল্প সময়ে পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রলোভন দেখানোসহ বিভিন্ন কৌশলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এমনকি পাসপোর্ট ফি জমা দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভুয়া সিল, সত্যয়ন, জাল ব্যাংক ভাউচার দেয়া, ভুয়া চিঠিপত্র তৈরি করা, ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের হয়রানি করে আসছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর আগারগাঁওসহ বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসে নিয়মিত অভিযান পারিচালনা করা হয়। সর্বশেষ আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়ে দালাল চক্রের ১৩ সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পাসপোর্ট অফিসগুলো দালাল চক্র থেকে মুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওই চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Nazmul miah ৪ অক্টোবর, ২০২১, ৩:৫৮ পিএম says : 0
দালালদের হাত কড়া পড়িয়ে কি সব সমাধা হয়ে গেল? আমার মতে, এখানে দালালদের সহযোগিতায় কর্মকর্তারা ঘোষ খায় তাই দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে আসলে পরবর্তী জনম ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়া যায় কি না তা বলাই বাহুল্য। তাই যদি ঘোষখুর অফিসারদের ঘোষ গ্রহন করা থেকে বন্ধ না করতে পারলে দালালদের হাতকড়া পড়িয়ে কোন লাভ নাই বরং আমরা সাধারণ জনগণের জন্য ঘোষের রেট আর বেশী বেড়ে যাওয়ার জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়া হয়।
Total Reply(0)
Magfar Uddin ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১, ২:১০ এএম says : 0
সরকারী কর্মকর্তাদের চাকরি যাওয়ার ভয় নেই, তাই তারা কেয়ার করে না। আমি গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখে একবার গেলাম মন্সুরাবাদ, চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে, ২ ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার পর, এই সমস্যা, সেই সমস্যা বলে বাদ করে দিল। আবার গতকাল গেলাম, প্রথমে ৩ নাম্বার কাউন্টার থেকে বাদ করল, তারপর ১০ নাম্বার থেকে বলল, ২০৪ এ যেতে, ২০৪ এ সহকারী পরিচালক উল্টো পুলিশে দেয়ার ভয় দেখালো! দালাল ছাড়া মন্সুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে যাওয়া মানে সময় লস ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি এখনও বুঝতেসিনা কোথায় গেলে এর সমাধান পাওয়া যাবে!
Total Reply(0)
Md.Abdul Ajad ২২ মার্চ, ২০২২, ১২:১২ পিএম says : 0
আসলে একজন মানুষ তার নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কখন যাওয়ার চিনতা করে শুধু এই একটি কথা যদি তারা চিন্তা করতো তাহলে এই কাজ গুলো করতো না কখনো
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন