শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যটনশিল্পকে গুরুত্ব দিতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলোর একটি পর্যটন। বাংলাদেশেও বিকাশমান এই খাতটি প্রচণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দেড় বছরেরও বেশি সময়ে এই খাতে মোট ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব উপখাত মিলিয়ে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান থাকলেও করোনার এ সময়ে বেকার হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগ কর্মী। এই অবস্থায় গত ১৯ আগস্ট কিছু শর্ত সাপেক্ষে পর্যটনকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদনকেন্দ্র খোলার অনুমতি দেয়া হয়। আশার কথা, এরই মধ্যে পর্যটন ব্যবসার পালে কিছুটা হলেও হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। বিদেশি পর্যটক না এলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের নিয়ে শিল্পটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। করোনা পরিস্থিতির অবনতি না হলে উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ধীরে ধীরে তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।

গত দেড় বছরে পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, ট্রান্সপোর্ট, ট্যুর অপারেটরস, ট্রাভেল এজেন্সিসহ পর্যটনের ৪১টি খাত বন্ধ ছিল। সেগুলো খুলে দেওয়া হলেও এই খাতের সব উপখাত সমানভাবে চালু হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। বিদেশি পর্যটক আসছে না। বিদেশি পর্যটক না এলে তিন তারকা থেকে পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর ব্যবসা জমে না। দেশ থেকেও পর্যটন ভিসা নিয়ে বাইরে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ফলে বিভিন্ন দেশে ট্যুর পরিচালনাকারী অপারেটররা ব্যবসা পাচ্ছে না। তবু মন্দের ভালো, অভ্যন্তরীণ পর্যটন নিয়েই এই খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ট্যুরিজম বোর্ড, বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় প্রশাসনসহ সবাই চেষ্টা করছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যেন সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়। এদিকে ক্ষতিগ্রস্থ পর্যটনশিল্পকে চাঙ্গা করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এরই মধ্যে একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ক্ষতিগ্রস্থ শিল্পগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছেন, তার মধ্যে পর্যটনশিল্পও অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য পর্যটনসংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রণোদনার সঠিক বণ্টন যেন নিশ্চিত করা হয়।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের মোট জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ আসে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এ খাতের অবদান ছিল ২ হাজার ৯৩৯ বিলিয়ন ডলার যা মোট অর্থনীতির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনে কর্মসংস্থান ছিল ১৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, যা মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৩ ভাগ। গত পাঁচ বছরে প্রতি পাঁচটি নতুন চাকরির একটি সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতে। এ অঞ্চলে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা খরচ করে ৫২৯ বিলিয়ন ডলার, যা পুরো রপ্তানি আয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ৮১ ভাগ ভ্রমণ করেন অবসর কাটাতে, বাকিরা ব্যবসায়িক কাজে। বাংলাদেশ সম্পর্কে চলতি বছর সংস্থাটি কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে পর্যটন থেকে, যেখানে বাংলাদেশে এই খাতের অবদান ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল পর্যটন খাতে, যেখানে বাংলাদেশে ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে ২০১৭ সালে বিদেশি পর্যটক থেকে থাইল্যান্ড আয় করে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের আয় ছিল মাত্র দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। বিদেশি পর্যটক থেকে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মিয়ানমারের আয়ও ছিল বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যটন বোর্ডে পাঠানো হিসাব অনুযায়ী, গত বছর বিদেশি পর্যটক থেকে বাংলাদেশের আয় দশমিক ০২ শতাংশের মতো বেড়েছে। তারপরও বলবো, বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইকো-ট্যুরিজম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ নানা দিক থেকে দেশের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌ-পর্যটনেরও অনেক সুযোগ রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। আমরা আশা করি, পর্যটনশিল্পের বিকাশে সম্ভাব্য সব কিছুই করা হবে।

প্রাকৃতিক নৈসর্গের লীলাভূমি খ্যাত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। অপূর্ব সৌন্দর্যবিস্তৃত এ দেশ যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের টেনেছে। দুনিয়াজুড়ে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মহামারী করোনায় থমকে গিয়েছিল এ শিল্প। সমুদ্রসৈকত, চিড়িয়াখানা, থিম পার্কসহ সবখানে বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করোনায় পর্যটন খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। করোনার মধ্যে দেশের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ট্যুরিস্ট স্পট বন্ধ ছিল। রাঙামাটি পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে বুকিং শুরু হয়েছে হোটেল-মোটেলগুলোয়। অগ্রিম বুকিং হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলেছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্রপাড়ে নেমেছে পর্যটকের ঢল। খোলা হয়েছে সব হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। খুলেছে রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সাগরপাড়ের ঝুপড়ি দোকান, ছাতা-চেয়ার। সমুদ্রসৈকত ছাড়াও চেনারূপে ফিরতে শুরু করেছে বিনোদন কেন্দ্রগুলো। স্বস্তিতে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ সব বিনোদন কেন্দ্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের মনে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রমণপিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এখন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পর্যটনশিল্পের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যাশিত অবকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি দেশেই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের আয় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় ও উন্নত করে তুলতে সরকারি পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব দেশে সমুদ্রসৈকত আছে, সেখানে সারা বছর পর্যটকের আধিক্য থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশে। শুধু সমুদ্রসৈকত নয়, আমাদের দেশে পাহাড়ও আছে, আছে দর্শনীয় অনেক ঐতিহাসিক পর্যটন স্পট।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ কেন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারছে না সে বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট বা টিএস-এর মাধ্যমে পর্যটন খাতের আন্তর্জাতিক মান, ধারণা ও সংজ্ঞা অনুযায়ী পণ্য ও সেবার মূল্যায়ন করা হয়। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডাব্লিউটিও) নির্দেশনা অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ টিএসএ তৈরি করলেও বাংলাদেশে গত চার দশকেও এর জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। এই একটি কাজ করা সম্ভব হলেই আমাদের জিডিপিতে পর্যটন খাত ও প্রতিটি উপখাতের অবদান সম্পর্কে জানা যাবে। পর্যটন নিয়ে ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা করা আরো সহজ হবে। একই সঙ্গে পর্যটনে আমাদের কোন খাতটি দুর্বল, কোনটি সবল তাও চিহ্নিত হবে। শুধু বিদেশি পর্যটক নয়, বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাতে কত ব্যয় করে এবং প্রতিবছর কতজন দেশের ভেতরে ভ্রমণ করে, তা বের করা যাবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান করণীয় হচ্ছে, পর্যটন স্পটগুলোকে প্রডাক্ট হিসেবে তৈরি করা। বিপণনের আগে পর্যটন পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পর্যটন ব্যবস্থাপনা অতি গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটনকেন্দ্রগুলোর যথাযথ উন্নয়ন করা সম্ভব হলে বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি দেশের পর্যটকদেরও আকৃষ্ট করা সহজ হবে। আমরা আশা করব, পর্যটনশিল্পের অবকাঠামো ও পর্যটন প্রডাক্ট উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন