ধরলা নদীর পলি মাটি দিয়ে তৈরি ফুলবাড়ির জনপদ। মোগলহাটের কাছে পশ্চিমবঙ্গে হতে বাংলাদেশের ফুলবাড়িতে প্রবেশ করে চিলমারিতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। ধরলা নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার উৎস। যুগ যুগ ধরে ধরলার চরের চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত, সবজিক্ষেত, কলাবাগান, ঝাঁউবন, লাটাবন আর শরতের মন হারানো সাদা কাশফুল এনে দিয়েছে শান্তি ও প্রশান্তি। সুজলা-সুফলা প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্রের এ ভূমি হাতছানি দিচ্ছে মনুষকে। মাইলের পর মাইল দৃষ্টিনন্দন ভূমির ধানক্ষেত অপরূপ মোহনীয় হয়ে ধরা পড়ে। চরের সারি সারি কলাগাছ, কাশবন, ঝাঁউবন, কাটাবন, শুধু মানুষের প্রাণজুড়ায় না, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দও এনে দেয়। সুজলা-সুফলা ফুলবাড়ি ধরলা নদীর অবদান। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের ফসলের কদর ছিল দেশজুড়ে। উৎপাদিত ধান, পাট, সরিষা, সুপারি, পান, পেঁপে, কুমড়া চলে যেতো সারাদেশে ও বিদেশে। উত্তর অঞ্চলের কিংবদন্তির চাঁদ সওদাগর তার চৌদ্দ ডিঙ্গায় ভরে এ অঞ্চলের কৃষিপণ্য ধরলা নদী পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেতেন। বিনিময়ে বিদেশ থেকে নিয়ে আসতেন মূল্যবান পাথর ও সোনা রূপার বিভিন্ন অলঙ্কার। চাঁদ সওদাগরের চৌদ্দ ডিংগার স্মৃতিচিহ্ন এখনও এ অঞ্চলের বিভিন্ন জনপদে দেখা যায়। ধরলার বরালি, কর্তি, চিলকি, আইড়, বাঘাআইড়, বাইন, বোয়াল, প্রভৃতি মাছের সুনাম সারাদেশে।
কুড়িগ্রামের বিখ্যাত ভাওইয়া শিল্পী কছিমউদ্দিন ধরলা নদীর মাছের প্রশংসা করে গেয়েছিলেন, ধরলা নদীর ফলুয়া কর্তি তেলে ভাজা করেছে-জামাই এসেছে শশুর বাড়িতে। ধরলার সুস্বাদু মাছ দিয়ে জামাই আদর হলেও মাছগুলো এখন নদী থেকে বিলুপ্তপ্রায়।
এক সময় ধরলার চরে দাপিয়ে বেড়াত গরু মহিষের পাল। গৃহস্থদের পালে যতবেশি গরু-মহিষ থাকতো তার সামাজিক মর্যাদা তত বেশি হত। মহিষের পিঠে চরে দোতারা বাজিয়ে নিজের জীবণের সুখ-দুঃখ, প্রেম, ভালবাসা, নিয়ে মুখে মুখে ভাওয়াইয়া গান বাধত মহিশালরা।
এসব গানে এঅঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, সরল জীবণযাপন এবং খোলা মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ৩০-৪০বছর আগেও নদীর দুপাশের বাঁশঝাড়ে, বনে-বাদারে, দেখা যেত ডাবকি, শল্লী, বক, শালীক, হাড়গিলা, চখা-চখি, কোড়া ইত্যাদী পাখি।
পানি শুকিয়ে দিনে দিনে নদী মরে যাচ্ছে। ধরলার বুকে জেগে ওঠেছে অসংখ্য চর। ফসলের ঢেউখেলানো সবুজ সমাহার আর শরতের কাশফুল। বিশাল পরিস্কার লীল আকাশ, সাদামেঘের নানা রকম ভাষ্কর্য, বাতাসে ঢেউ খেলানো জাদুতে অতুলনীয় হয়েউঠে ধরলার সেই অতীত রুপ-লাবণ্যকে স্বরণ করলেও ধরলা আজ ধংসের পথে। ফারাক্কা বাধের কারনে নাব্যতা হারিয়ে ধরলার বুকে অসংখ্য চর পরলেও সেখান ঝাঁউবন, কাটাবন ও কাশফুল হওয়ার সুজোগ নেই বললেই চলে। বিশাল চরে রাখালের বাঁশির সুর আর শোনা যায় না। সারাদিন চলে চরের বুক চিরে কৃষকের খোঁড়া খুড়ি। খাদ্যের প্রয়োজন শরতের কাশফুলের সৌন্দর্য্য আর মানূষের মনে দোলা দেয় না।
অনেকে নদীও মেরে ফেলে খেতে চায়। তবুও শরতের এই অবিছেদ্দ সৌন্দর্য্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। শুধু খাদ্য নয় সৌন্দর্য্য মানুষের মনকে সিগ্ধ এবং আলোকিত করে। ধরলার অবশিষ্ট সৌন্দর্য্য টুকু রক্ষা করার দায়িত্ব মানুষেরই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন