হজরতের অসুস্থতার সূচনা হওয়ার একদিন আগে তিনি উসামা (রা.)-কে রোমানদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন। হুজুর (সা.) স্বহস্তে উসামাকে পতাকা সমর্পণ করেন। কিন্তু তাঁর রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় তখন এই অভিযান প্রেরণ মুলতবী রাখা হয়। হযরত আবু বকর (রা.) খলিফা হওয়ার পর এই বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়।
অবশ্য ভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হুজুর (সা.)-এর রোগের সূচনার পরের দিন তিনি উসামা (রা.)-কে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রোগের সূচনা সর্ম্পকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। মুসনাদে ইমাম আহ্মদ ও নাসায়ীতে ওবায়দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা বর্ণনা করেন যে: হজরত আয়েশা (রা.) বলেন : ‘একদা জান্নাতুল বাকীতে একজন সাহাবীর দাফন সম্পন্ন করে রসূলুল্লাহ (সা.) গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন আমার মাথা ব্যথা ছিল। তখন হুজুর (সা.) ও তাঁর মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে বলে জানান।’ অনেকের মতে হুজুর (সা.) রোগের সূচনা এখানেই।
হিজরি একাদশ সালের ১৮ অথবা ১ সফর মধ্য রাতে হুজুর (সা.) মদীনার প্রসিদ্ধ কবরস্থান জান্নাতুল বাকীতে সাহাবাগণের কবর জেয়ারত করেন এবং সেখানেই তিনি অসুস্থতা বোধ করতে থাকেন। দিনটি ছিল বুধবার। রসূলুল্লাহ (সা.) ওফাতের পূর্বে কতদিন অসুস্থ ছিলেন তাতে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে তিনি রোগের সূচনা থেকে মোট তের দিন অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন এবং বুধবার থেকেই রোগের সূচনা হয়েছিল। রসূলুল্লাহ (সা.) এর রোগের সূচনা দিবস বুধবার। এতদঞ্চলে সফর মাসের শেষ বুধবার ‘আখেরী চাহার সোম্বা’ নামে পরিচিত। ফারসী ভাষায় বুধবারকে ‘চাহার সোম্বা’ বলে।
বিদায় হজ্জের দিন এই আয়াতটি নাজেল হয়। ‘আল-ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম, ওয়া আতমামতু আলাইকুম নে’মাতী, ওয়া রাদ্বীতু লাকুমুল ইসলামা দীনান’ অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পন্ন করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।
আয়াতটি নাজেল হওয়ায় বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, দ্বীন যখন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর রেসালাতের দায়িত্বও পালন করেছেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে তাঁর কাছে ডেকে পাঠাবেন। অতঃপর হুজুর (সা.) আরাফাতের ময়দান থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং বলেন: সম্ভবত, তোমাদের সাথে আমি আর হজ্ব করতে পারব না ।
এই বিদায় বাণী এতই স্পষ্ট ছিল যে, এই হজ্বের নামই বিদায় হজ্ব নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হুজুর (সা.) যে খুতবা দান করেন, তাতে পরিষ্কারভাবে খবর দেয়া হয় যে, ‘আমার রব সম্ভবত: এখন আমাকে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নেবেন এবং আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দেব।’ এই জন্য তিনি কতিপয় উপদেশ দান করেন।
এই স্থানে হুজুর (সা.) সকল সাহাবাকে একত্রিত করে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দান করেন এবং তাতে হামদ-সানার পর বলেন: হে লোক সকল! আমিও একজন মানুষ। সম্ভবত আল্লাহর ফেরেশতা দ্রুত আসবেন এবং আমাকে গ্রহণ করবেন (অর্থাৎ মৃত্যু আসবে)। আমি তোমাদের মধ্যে দুটি ভারি জিনিস রেখে যাচ্ছি- একটি আল্লাহর কিতাব, যাতে হেদায়েত ও আলো রয়েছে । আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং অপর জিনিসটি হচ্ছে আমার আহলে বায়ত। ‘আমি আমার আহলে বায়ত সর্ম্পকে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’ শেষ বাক্যটি তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন।
রসূল (সা.) বিদ্বেষী ইহুদী খবিসদের কালিমাযুক্ত অন্তরের একটি ঘৃণ্য ঘটনা দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই, যা প্রমাণ করে যে, তাদের অনেকেই রসূল (সা.) এর জীবনকে তাদের বিষাক্ত-হলাহল মনে করত এবং তার উপস্থিতিই গোস্তাখ-কমবখতরা তার মৃত্যু কামনা করার স্পর্ধা প্রদর্শনে দ্বিধা বোধ করত না।
বিভিন্ন হাদীস হতে জানা যায় যে, ইহুদীদের সর্ম্পকে সূরা মোজাদালাহ এর ৮নং আয়াতটি নাজেল হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে : আর যখন আপনার সম্মুখে উপস্থিত হয় তখন এমন বাক্য দ্বারা আপনাকে অভিবাদন জানায় যেসব শব্দ আল্লাহ আপনার সম্মানের ক্ষেত্রে বলেননি; হাদীস অনুযায়ী, ‘আস্সালাম’ শব্দের পরিবর্তে ‘আস্সাম’ বলত, এর অর্থ মৃত্যু। তিনি জবাবে শুধু ‘ওয়া আলাইকা’ (অর্থাৎ তোমার প্রতিও) বলতেন। একবার হজরত আয়েশা (রা.) আস্সামু আলাইকা এর জবাবে ইহুদীকে ‘আলাইকা আসসামও ওয়াল্লা নাতু’ (তোমার প্রতি মৃত্যু ও অভিশাপ হোক) বললেন। হুজুর (সা.) তাঁর পরিপূর্ণ উত্তম চরিত্রগুণে এ জবাব পচ্ছন্দ করলেন না।
ইহুদীদের ন্যায় মোনাফেকরাও অনুরূপ গোস্তাখী প্রদর্শন করত বলে বর্ণিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, একটি হাদীসে রসূলুল্লাহ (সা.) ‘সাম’ শব্দটি এভাবে ব্যবহার করেছেন: ‘লি-কুল্লি দায়িন দাওয়া উন ইল্লাছ সাম’ -অর্থাৎ মৃত্যু ব্যতীত প্রত্যেক রোগের নিরাময় আছে ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন