বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নতুন শক্তির উত্থান

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

করোনা বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্যবাদে ধস এনেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের এখন ক্রান্তিকাল চলছে। করোনায় বিপর্যস্ত হওয়া এবং আফগানিস্তানে বিশ বছরের মিশনে পরাজিত হওয়ায় তার অবস্থান কিছুটা হলেও নাজুক হয়ে পড়েছে। দেশটির বিশিষ্টজনরাও বলছেন, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণকে দায়ী করছেন এবং দেশটিকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করেননি। দেশটির প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি নিজ দেশের সমালোচনা করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রধান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ও বিশ্বশান্তির জন্য বৃহত্তম হুমকি। তবে চমস্কির আগে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের শাসনামলে রবার্ট জার্ভিস এবং স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেছিলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশই যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের ‘প্রধান সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ এবং তাদের সমাজের জন্য বৃহত্তম বহিরাগত হুমকি মনে করে। বারাক ওবামার সময় আন্তর্জাতিক এক জরিপে বলা হয়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বিবেচিত। এসব মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি। বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীতে কোনো আগ্রাসী শক্তিই দীর্ঘসময় বিচরণ বা দাপিয়ে বেড়াতে পারেনি। একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সে জায়গায় নতুন শক্তির উদ্ভব হয়েছে। লোহা-লক্করের অস্ত্রের পরিবর্তে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের মূল নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে অর্থনীতি। এ প্রতিযোগিতায় যে এগিয়ে থাকবে, সেই হবে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় তার চিরশত্রু সোভিয়েট ইউনিয়নকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়ার জন্য জোর তৎপর ছিল। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েট ভেঙ্গে গেলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। এক্ষেত্রে, তার মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অস্ত্রবাজী ও যুদ্ধ নীতি। বিভিন্ন দেশে আগ্রাসী হামলা ও মদদ দিয়ে আধিপত্য বিস্তার এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে তা দমনের নামে এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলার নীতি অবলম্বন করে চলে। তার এই অপনীতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সমৃদ্ধ দেশকে সে ধ্বংস করেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও শক্তির প্রদর্শন করেছে। তবে এ ধরনের জোর-জবরদস্তিমূলক নীতি চিরকাল থাকে না। কোনো না কোনো সময় বিকল্প শক্তি দাঁড়িয়ে যায়। এখন এই বিকল্প শক্তির উত্থানেই সে ক্রমে বিশ্বে তার অবস্থান হারাচ্ছে। পুরনো শত্রু রাশিয়া, নবশক্তি চীন, তুরস্কসহ অন্যান্য শক্তির উত্থান তাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে দাঁড়াবার নানা ফন্দি-ফিকির শুরু করছে। তাতে কতটা সফল হতে পারবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।

দুই.
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার অবস্থান সুসংহত করতে মিত্রদের নিয়ে এখন নতুন নতুন জোট গঠনে উদ্যোগী হয়েছে। পূর্ব এশিয়া ও উপমহাদেশে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্যাট্রেজি নামে জোট গঠন করেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পূর্ব এশিয়ার সংযুক্তি এবং ভারত ও প্রশান্ত মহাসগরে তার ও মিত্রদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যেই এ জোট গঠন করা হয়েছে। এ জোট ভারতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এর কারণ, চীনের ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধি ও উপমহাদেশের দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের শৈথিল্য তার আধিপত্য খর্ব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে ওঠায় তার আধিপত্য হ্রাসের আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের শত্রু (চীন) অভিন্ন হওয়ায় তারা জোট গঠনে উদ্যোগী হয়। চীনের সাথে জাপানের ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কের টানাপড়েনের সূত্র ধরে জাপান এ জোটে যুক্ত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ধামাধরা হওয়ায়, সেও যুক্ত হয়েছে। এ জোটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৌশলগত কারণে এ জোটে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। তবে পরিবর্তীত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই জোট কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। কারণ, চীন ইতোমধ্যে এ অঞ্চলে তার শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। দেশটি যেভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে তার বন্ধুত্বসুলভ আচরণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাদের এই ব্যর্থতায় দেশগুলো চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে ভারতের দীর্ঘদিনের আধিপত্য ও দাদাগিরিতে আঘাত লেগেছে। অন্যদিকে, বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠায় চীনকে ঠেকানোর নানা উপায় অবলম্বন করে চলেছে। এতে চীন যতটা না উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। চীন তার মতো করেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটি ভালো করেই জানে, বিশ্বে অর্থনীতি ও সমরাস্ত্রের দিক থেকে সে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা ঠেকানোর মতো সামর্থ্য এ মুহূর্তে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কারণ, সে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর পাশে বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগ্রাসী মনোভাব নেই। দেশগুলোও চীনের বাড়িয়ে দেয়া হাত আঁকড়ে ধরছে। চীনের এই শান্তনীতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের আগামী অর্থনীতির নেতৃত্ব দেবে এশিয়ার দেশগুলো এবং এর অগ্রভাগে থাকবে চীন। ইতোমধ্যে চীনের এ নেতৃত্বের ছাতার নিচে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ শামিল হয়েছে। সুদূর থেকে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে আধিপত্য বিস্তার করা অসম্ভব। ফলে সে ইন্দো-প্যাসিফিক জোট গঠন করে তা সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, ভারত দীর্ঘদিন থেকেই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বৈরী আচরণ করে আসছে। বৃহৎ দেশ হওয়ায় দেশগুলোও অনেকটা নীরবে তা মেনে নিয়েছে। তবে দাদাগিরি ও আধিপত্যবাদ যে সবসময় সমান্তরালে যায় না, ভারত তার দম্ভের কারণে সেটা বুঝতে পারেনি। ইতোমধ্যে মোদীর শাসনাধীন ভারতের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ায় আভ্যন্তরীণ সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। করোনা তা আরও করুণ করে তুলেছে। নিজ দেশের আভ্যন্তরীণ সংকট সামাল দেবে নাকি প্রতিবেশীর ওপর আধিপত্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেবে-এমন এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এ সুযোগে চীন দেশগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এতেই তার প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ভারতকে লাদাখ সীমান্তে চাপে রেখেছে। ক্রমাগত সৈন্য মোতায়েন করে চলেছে। এতে ভারতও শঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। উপমহাদেশে ভারতকে চাপে রেখে চীন তার প্রভাব বিস্তারের প্রথম প্রকাশ্য কাজটি করে গত বছর লাদাখে কমবেট যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতকে পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে। এতে ভারতের আধিপত্য অনেকটাই খর্ব হয়ে পড়ে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো ভারতের প্রভাব বলয় থেকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দেশগুলোর ঝুঁকে পড়ার যৌক্তিক কারণও রয়েছে। বিপদে যে পাশে দাঁড়াবে, তার দিকেই তারা ধাবিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মিলিয়ে আফগানিস্তানে ভারত বিগত বছরগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। তবে রাতের আঁধারে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়ন এবং তালেবান সরকারের উত্থানে ভারত এখন বিপাকে পড়ে গেছে। তালেবান সরকার গঠনের আগেই চীন তার পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে আফগানিস্তানও ভারতের হাতছাড়া হয়ে গেছে। উপমহাদেশে ধারাবাহিক কর্তৃত্ব হারানো এবং সম্পর্ক আলগা হয়ে পড়ায় ভারত এখন উদ্বিগ্ন।

তিন.
যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকাতে সম্প্রতি নতুন এক জোট গঠন করছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর দেশটি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হঠাৎই একটি বিশেষ কৌশলগত নিরাপত্তা চুক্তির ঘোষণা দেয়। এই চুক্তির নাম দেয়া হয়েছে অকাস (এইউকেইউএস)। এটি গঠন করা হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী, এই তিন দেশের অংশীদারিরর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরি করবে। চুক্তির অধীনে অন্যান্য বিষয়েও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সামরিক চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। চুক্তির উদ্দেশ্য হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চীনকে প্রতিহত করার বিষয় উল্লেখ করা না হলেও, বুঝতে অসুবিধা হয় না, চীনের উদীয়মান শক্তিকে বিশেষ করে তার সামরিক ও নৌশক্তিকে প্রতিহত করাই এর মূল লক্ষ্য। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে তার পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন প্রযুক্তি প্রদান করবে এবং তার আওতায় অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ডকইয়ার্ডে ৮টি সাবমেরিন তৈরি করবে। ১৯৫৮ সালে যুক্তরাজ্যকে এই প্রযুক্তি দেয়ার পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি দেশকে এই প্রযুক্তি দিতে যাচ্ছে। এতে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়বে এবং এর মধ্য দিয়ে কৌশলগত এই অঞ্চলে নতুন মেরুকরণ শুরু হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে এবং এতে অপারেশনাল পরিধি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এ প্রেক্ষিতে, অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যাবে এবং তার নৌবাহিনী ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে তাদের নজরদারি ও টহল বাড়াতে পারবে। এসব সাবমেরিনে পারমানবিক অস্ত্র থাকবে না, তারা প্রচলিত অস্ত্র বহন করবে। এদিকে অকাস চুক্তির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ক্ষুদ্ধতার কারণ, ২০১৬ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ১২টি ইঞ্জিনচালিত সাবমেরিন তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং সেই সহযোগিতার চুক্তি বেশ কিছুদূর এগিয়েছিল। ফ্রান্স এই সাবমেরিনগুলো ২০৩৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে দেবে বলে নিশ্চিত করেছিল। এখন অকাস চুক্তির কারণে অস্ট্রেলিয়া ৯০ বিলিয়ন ডলারের এই ক্রয়াদেশ বাতিল ঘোষণা করেছে। এ ঘটনায় ফ্রান্স চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তার মতে, এটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ফ্রান্সের এক মন্ত্রী বলেছেন, এটা শুধু চুক্তি ভঙ্গই নয়, এটা তাদের পিঠে ছুরিকাঘাতের শামিল। ফ্রান্স এ কথাও বলেছে, তারা ন্যাটোর মিলিটারি কমান্ডের অন্তর্ভুক্ত থাকা নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করবে। ফ্রান্স আশা করেছিল, মিত্রদেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সঙ্গে নিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা করবে এবং নতুন কৌশলগত অবস্থানে তাকে অন্তর্ভুক্ত করবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ন্যাটো ও আন্ত-আটলান্টিক সম্পর্ক অনেক বছরে এমন সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। অকাস চুক্তির কারণে এর সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ন্যাটো জোটে পড়বে। তারা মনে করছেন, অকাস চুক্তি মূলত চীনকে ঠেকানোর জন্যই করা হয়েছে। এতে চীনও যে চুপচাপ বসে থাকবে তা মনে করার কারণ নেই। বর্তমানে চীনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির যে গতি, তা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। দেশটির নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণের যে প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তা আরও বেগবান হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার নৌ সক্ষমতা বৃদ্ধি চীনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করবে। তবে এর প্রতিক্রিয়ায় যদি চীনের সামরিক শক্তি ও পরিধি বৃদ্ধি পায়, তাহলে এর ফলাফল কি হবে তা অনুমান করা কঠিন। বিশ্লেকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার আধিপত্য ধরে রাখতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে চীনকে ঠেকানো যেমন কঠিন হবে, তেমনি এ অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে। এতে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না। দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার আধিপত্য ধরে রাখতে বেশ বিচলতি হয়ে পড়েছে। এ কারণে একের পর এক নতুন জোট গঠন করছে। এতে ন্যাটোর মতো শক্তিশালী জোটেও তার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।

চার.
চীনকে ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এত আয়োজন ও প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে এক্ষেত্রে চীন যে শুধু একা তা মনে করার কারণ নেই। ইতোমধ্যে তার সাথে রাশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের সাথে একটি শক্তিশালী বলয় গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তারা একে অপরের কাছাকাছি অবস্থান করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ সে জানে, সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বিশ্বে তার আধিপত্য বিস্তারের মূল অস্ত্র অর্থনীতি। মানুষ যুদ্ধের মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে পড়তে চায় না। তারা চায়, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে শান্তিতে বসবাস করতে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও তার পুরনো যুদ্ধনীতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। এ কথা বুঝতে পারছে না, এখন আর মোড়লগিরি ও হুমকি-ধমকিতে কোনো দেশকেই দমিয়ে রাখা যায় না। করোনা এটা বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের জীবনমান ও বেঁচে থাকার একমাত্র শক্তি হচ্ছে অর্থনীতি। যে দেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে আসবে, তাকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে। চীন এ কাজটিই করছে। উপমহাদেশসহ করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ নিয়ে তাদের কাছে টেনে নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাপী উন্নত, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তার সাথে থাকবে। বলা বাহুল্য, পূর্ব এশিয়া ও উপমহাদেশে চীন গভীর মনোযোগী হওয়ায় তার প্রভাব আগের চেয়ে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ভারত অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ও আধিপত্যবাদ দেশগুলো আগের মতো আমলে নিচ্ছে না। অন্যদিকে, তুরস্কও উপহাদেশে তার সম্পর্কন্নোয়নে মনোযোগী হয়েছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করছে। বাংলাদেশের সাথেও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে তুরস্কের অস্ত্র কেনার জন্য বাংলাদেশের সাথে কথাবার্তা হয়েছে। বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচনে উদ্যোগী হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, চীনের পথ ধরে তুরস্কও উপমহাদেশে তার প্রভাববলয় সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান চীনের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে উপমহাদেশে চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং তাদের বলয়ভুক্ত দেশের প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একে নবশক্তির উত্থান বললে অত্যুক্তি হবে না।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন