শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি

মাওলানা মুহাম্মদ মামুন | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

ইসলাম মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেয়। নিজেদের ঐক্য, সংহতি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখা অবশ্যকর্তব্য। যে সকল কর্মকান্ড উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে তা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে (কোরআন) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, বিভেদ কোরো না। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)।
হযরত ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মুসলিম কাফেলার সঙ্গে মিলে থাকো এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা পরিহার করো। কারণ, শয়তান থাকে সঙ্গীহীনের সঙ্গে। দুজন একসঙ্গে থাকলে সে দূরে থাকে। যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যভাগ চায় সে যেন জামাতের সঙ্গে মিলে থাকে। (সুনানে তিরমিযী : ২১৬৫)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর সাহায্য রয়েছে জামাতের ওপর। যে বিচ্ছিন্ন হয় সে জাহান্নাম অভিমুখে বিচ্ছিন্ন হয়। (সুনানে তিরমিযী : ২৩০৫)। নুমান ইবনে বশীর রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে বসে বলেছেন, দলবদ্ধতা হলো রহমত, বিচ্ছিন্নতা হলো আযাব। (যাওয়াইদুল মুসনাদ : ১৪৪৯, ১৯৩৫০)। হযরত আবু দারদা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা দলবদ্ধ থাকো, কেননা নেকড়ে সঙ্গীহীন ভেড়াকে খেয়ে ফেলে। (সুনানে নাসায়ী : ৮৪৭)।
এ কারণে সর্বযুগে কাফেররা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালিয়েছে। সে চৌদ্দ শ বছর থেকে আজও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। ঐক্য বিনষ্ট হলে মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় ও পরাজয় নেমে আসে। শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ কারণে তিন বছর তাকে মাল্টার দ্বীপে অন্তরীণ করে রাখে ব্রিটিশ সরকার। তিনি একবার এক মজলিসে বলেছিলেন, আমি আমার পুরো জীবনে একটিই সবক শিখেছি, তা হলো মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের কারণ দুটি :
এক. কোরআনে কারীম ছেড়ে দেওয়া। দুই. পরস্পরের বিভেদ ও অনৈক্য। এখন আমার বাকি জীবনের মিশন ও লক্ষ্য হলো, এ দুটি সমস্যা দূর করা। কোরআন শিক্ষা দেওয়া, এর প্রচার-প্রসার ঘটানো এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টির সর্বাত্মক চেষ্টা করা। (ইসলাম অর সিয়াসতে হাযেরা : ১১৫-১১৬)।
মদীনার আউস ও খাযরাজ গোত্রের মাঝে প্রাক ইসলামী যুগ থেকে প্রচন্ড শত্রুতা ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তাদের শত্রুতা পরম বন্ধুত্বে পরিণত হলো। তাদের এ ঐক্য ইহুদীদের সহ্য হলো না। তারা বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে লাগল। একবার দুই গোত্রের লোকেরা এক মজলিসে বসা ছিল। মজলিসে শাম্মাম ইবনে কায়স নামক এক ইহুদীও ছিল। সে এটাকে বিভেদ সৃষ্টির মোক্ষম সুযোগ মনে করল। এক ব্যক্তিকে ডেকে বলল, জাহেলি যুগে তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে একে অপরের বিরুদ্ধে যে কবিতা আবৃত্তি করত তুমি এ মজলিসে আবৃত্তি করে শোনাও। লোকটি কথামতো কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে তাদের পুরোনো যখম তাজা হয়ে উঠল। একপর্যায়ে যুদ্ধের দিন-ক্ষণ নির্ধারণের পর্যায়ে পৌঁছে গেল। বিষয়টি রাসূল (সা.) এর কানে যাওয়ামাত্র তিনি তাদের কাছে এলেন। তাদের সতর্ক করলেন। ফলে সে ফেতনা রোধ হয়। এরপর আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানের ৯৯ থেকে ১০৮ নং আয়াত নাযিল করেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর : ২/৯৮)।
১৯২৪ সালে খেলাফত ধ্বংসের জন্যও ইসলামের শত্রুরা এ বিভেদকেই কাজে লাগিয়েছিল। আরব ও তুর্কিদের মাঝে ঠুনকো জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়েছিল। মুসলমানরা আরব ও তুর্কি দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এখনো আরব-অনারব, বাঙালি-অবাঙালি, অমুক দেশি তমুক দেশি ইত্যাদি জাতীয়তাবাদ ও দেশত্ববোধের নামে মুসলমান বিভক্ত হয়ে পড়ছে। এ বিভেদ দিন দিন বেড়েই চলছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশকালেও তারা বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে বিভিন্নভাবে। ওহাবী, সুন্নী, কাদিয়ানী বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত করেছে। স্বাধীনতাকামী দেওবন্দীদের বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়াও জারি করেছে মুসলিম নামধারী কাদিয়ানী ও রেজাখানী ফেরকার মাধ্যমে। ব্রিটিশদের একটি বিখ্যাত রীতি হলো, উরারফব ধহফ ৎঁষব বিভক্ত করো, শাসন করো। অর্থাৎ কোনো জাতি যখন নিজেরা বিভেদে জড়িয়ে পড়ে তখন তাদের ওপর সহজেই বহিরাগতরা কর্তৃত্ব চালাতে পারে।
আজ আমরা অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। পৃথিবীর যেখানেই কোনো মুসলমান নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা আমাদের দেহেই আঘাত হানছে। যেখানেই কোনো মুসলমান সম্মান হারাচ্ছে তাতে মুসলিম উম্মাহর সম্মান খর্ব হচ্ছে। যেখান থেকেই কোনো মুসলমানের রক্ত ঝরছে তা উম্মাহর দেহ থেকেই ঝরছে। এর পরও আমরা শতধাবিচ্ছিন্ন। পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত। যারা পদে পদে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, আমাদের সমূলে শেষ করতে ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা করছে আমরা আজও তাদেরই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তাদের দুয়ারে ভিখারির থালা হাতে ঘুরছি। এখনো কি আমাদের বোধোদয় হবে না? আমাদের ফিরে আসতে হবে আল্লাহর দরবারে। ক্ষমা চাইতে হবে সকল গোনাহ থেকে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে, জীবনে যাই কিছু ঘটুক আমাদের মালিককে কখনো অসন্তুষ্ট করব না। তার বিধি-বিধান সর্বদাই মেনে চলব। দুনিয়াব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসারে দাওয়াত-তাবলীগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদে আত্মনিয়োগ করব। সমস্যার সমাধানে অন্যের দুয়ারে হাত পাতব না। মুসলিম উম্মাহ এক হয়ে এবং নেক হয়ে ন্যায়, ইনসাফ ও ইসলামের ওপর অবিচল থাকব। ইনশাআল্লাহ সে সোনালি দিন আর বেশি দূরে নয়, আঁধার যতই দীর্ঘ হোক, অচিরেই উঁকি দেবে আলোকিত ভোর।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন