ডিম স্মরণাতীত কাল থেকে সব বয়সী মানুষের পুষ্টির যোগান দিয়ে আসছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের কাছে ডিম পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য। এটি প্রকৃতির সর্বোচ্চ মানের একটি প্রোটিন উৎস, যাতে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল অ্যামিনো অ্যাসিড নিহিত রয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ডিমে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আরও অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যথা: লুটেইন এবং জেক্সানথিন, যা চোখের জন্য উপকারী; কোলিন, যা মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর জন্য দরকারি; এছাড়াও আছে বিভিন্ন ভিটামিন (এ, বি এবং ডি)। বস্তুত, ডিম সাশ্রয়ী মূল্যে শীর্ষ-মানের প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং বহুমুখী এমন একটি অনন্য ফুড প্যাকেজ যার কোনো তুলনা হয় না। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার আইটেম। বাংলাদেশে এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যে পরিবারে নিয়মিত খাবারের তালিকায় ডিম রাখতে চায় না।
এই যে বহু গুণে গুণান্বিত ডিম, তা কি আপনার জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে? সাধারণভাবে ডিম খেলে কিংবা অতিরিক্ত খেলে তা কি কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে? অন্যভাবে, বলা যায়, দিনে বা সপ্তাহে কয়টি ডিম খাওয়া নিরাপদ বিবেচিত হতে পারে? বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে, যা এখনও শেষ হয়নি। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডিমে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরলের উপস্থিতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি রক্তের বাজে কোলেস্টেরল (এলডিএল)-এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে? হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে কিংবা এহেন ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে? এসব বিবেচনায় দীর্ঘকাল এধরনের রোগ বা তার ঝুঁকিতে আছে এমন লোকদের জন্য ডিম, বিশেষ করে এর হলুদ অংশ একরকম অপাঙক্তেয়ই বিবেচিত হয়ে আসছিল। তবে, বহু বছরের গবেষণামূলে বিজ্ঞানীরা এরকম অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, রক্তের কোলেস্টেরল প্রধানত খাদ্যের সম্পৃক্ত ফ্যাট ও ট্রান্সফ্যাট থেকে লিভারে তৈরি হয়, এখানে খাবারের মাধ্যমে নেয়া কোলেস্টেরলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বলা ভালো, ডিমে খুব সামান্য পরিমাণ সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে, কোনো রকম ট্রান্সফ্যাট থাকে না।
এর ফলে ডিমের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। আপাতদৃষ্টিতে, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের চোখে সুদীর্ঘ কাল ধরে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত ডিমের একরকম প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে আজ আমাদের জ্ঞান যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার সারনির্যাস হলো: বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে দিনে একটি ডিম হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্য কোনো ধরনের কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায় না। তবে, আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে, অন্য কোনো কারণে (যেমন ধূমপান) হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকেন, কিংবা ইতোমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে সপ্তাহে তিনটির বেশি ডিম খাওয়া উচিত হবে না। হ্যাঁ, ডিমের সাথে আর কী কী খাওয়া হচ্ছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য খাবারে কতটা স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা ট্রান্সফ্যাট থাকছে তা বিবেচনায় নিতে হবে। তবে, মাত্রাতিরিক্ত ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতার বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন অতিরিক্ত অর্ধেক ডিম, অর্থাৎ সপ্তাহে সব মিলিয়ে তিন থেকে চারটি অতিরিক্ত ডিম খাওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগের ঝুঁকি ৬% এবং অসময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৪% বৃদ্ধি পেতে পারে।
ডিম নিয়ে উদ্বেগের আরেকটি কারণ, এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে সালমোনেলার সংক্রমণ এবং তার ফলে ফুড পয়জনিং হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে, রোগীকে হসপিটালাইজ করা লাগতে পারে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে, সালমোনেলা সংক্রমণ অন্ত্র থেকে রক্তপ্রবাহে এবং পরবর্তীতে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরিশেষে, সময় মতো ও যথাযথ চিকিৎসা ও পরিচর্যা না পেলে এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ডিমের খামারে বা বাড়ির পেছনে তৈরি মুরগির ঘরে সম্ভাব্য অনেক সূত্রেই সালমোনেলা সংক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যেসব লোক ডিম উৎপাদনের খামারে কাজ করছে, ইঁদুর, হাঁস-মুরগির খাবার কিংবা ধূলি-বালি। সাধারণত, এসব জীবাণু আক্রান্ত মুরগির মলমূত্র থেকেই ডিমের গায়ে লাগে। পরবর্তীতে ডিমের খোলসে বিদ্যমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিদ্রপথে ভেতরে প্রবেশ করে বংশ বৃদ্ধিও করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সমস্যার সমাধান কী? কেউ হয়তো বলবেন, খামারিরা ডিম ভালো মতো ধুয়ে বাজারজাত করলেই তো হয়। তবে, এতে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। ডিমের গায়ে একটা পাতলা আবরণ থাকে, যা খোলসের সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো বন্ধ করে রাখে এবং এভাবে ডিমের বাহির থেকে ভিতরে জীবাণুর প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ডিম ধুলে এ আবরণটি চলে যায়, ফলে ডিমের ভিতরে জীবাণুর প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হয়। তাহলে উপায়? এখানে খামারিদের দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশি। মুরগির থাকার জায়গা, বিশেষ করে যেখানে ডিম পাড়ে, সেটা নিয়মিত ভালভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা চাই। আর ভোক্তা হিসেবে করণীয় হলো, ডিম ধরার আগে-পরে হাত ও তৈজসপত্র ভালো মতো সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। ডিম ভালো মতো সিদ্ধ করে নিলে এসব জীবাণু মারা পড়ে। অর্ধসিদ্ধ কিংবা কাঁচা ডিম অথবা যেসব খাবারে এরূপ অবস্থায় ডিম ব্যবহার করা হয়েছে, তা পরিহার করতে হবে। বাচ্চা, বুড়ো, গর্ভবতী মহিলা এবং ডায়াবেটিস কিংবা অন্য কোনো রোগের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এমন লোকদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) মতে, কক্ষ তাপমাত্রায় ডিমের গায়ে জলকণা ঘনীভূত হতে পারে, যা ডিমের খোলস ভেদ করে ভেতরে ব্যাকটিরিয়া প্রবেশের পথ সুগম করে দেয়। ডিম রেখে দিলে সময়ের সাথে এই ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। কারণ, যত সময় গড়ায় ডিমের সুরক্ষাদানকারী বাধার প্রাচীর ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। কাজেই, ডিম ফ্রিজে রাখতে হবে এবং ‘সর্বোত্তম মেয়াদ’ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই খেয়ে ফেলতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের দেশে এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিম বিপণনের ক্ষেত্রে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
যেহেতু পুরো সমস্যার প্রধান উৎস হচ্ছে, খামার পর্যায়ে ডিমের জীবাণু-দূষণ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। খামারিদের সচেতন করার জন্য যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং তাদের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করা হয়, তাহলে ডিমের মাধ্যমে এধরনের সংক্রমণে বিস্তারের সম্ভাবনা বহুলাংশে কমে আসবে।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন